বোরোর বাম্পার ফলনে গোলা ভরার আশা

মহামারীর কালে ‘হিট শকে’ কিছু ফসলহানি হলেও এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। আর তাতে সরকারের খাদ্য মজুদও বাড়ার সুযোগ হবে।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2021, 07:52 PM
Updated : 25 April 2021, 08:22 PM

এবার বোরো মৌসুমে সারাদেশে ২ কোটি ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনে লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।

কৃষকরা বলছেন, পরিমিত বৃষ্টি, শীত কম থাকা, উচ্চ ফলনশীল জাত আবাদ বেশি হওয়ার কারণে এবার ফলন বেশি।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন কোনো বিপর্যয় না ঘটলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

দেশে আমনের মৌসুম শেষ হবার পর বোরো ধান রোপণ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসের দিকে। ধান কাটা চলে এপ্রিল-জুন মাস পর্যন্ত।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ধানের আবাদ হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে।

গত বছরের তুলনায় এবার ৭৮ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। আর এবার হাইব্রিড জাতের আবাদ বেড়েছে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে।

গত দুই বছর আকস্মিক বন্যায় হাওরে বোরোর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এবার তেমনটা ঘটেনি।

ক্ষেত পরিদর্শন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মৌলভীবাজার অঞ্চলের উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফলন খুবই ভালো হয়েছে, এখন গোলায় ধান উঠাতে পারলেই পরিপূর্ণ তৃপ্তি আসবে।”

তিনি জানান, এ বছর মৌলভীবাজার জেলায় ৫৬ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে তিন হাজার হেক্টর বেশি। জেলায় এ বছর আট হাজার হেক্টর হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ হয়েছে।

আগামী সপ্তাহে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় মাঠের পাকা ধান যত দ্রুত সম্ভব কেটে গোলায় উঠানোর জন্য কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।

এবার মৌলভীবাজারে নিয়মিত জমির বাইরে অনাবাদী তিন হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

পতিত জমি চাষের আওতায় আনা শ্রীমঙ্গলের মীন নগরের কৃষক জুবের মিয়া জানান, তারা কৃষি বিভাগের পরামর্শে ও সহায়তায় এ বছর প্রথমবারের মত হাইব্রিড জাতের ধানের চাষাবাদ করেন।

“এই ধান আশার চেয়েও বেশি ফলন দিয়েছে। পতিত জমিতেই যে ফলন পেয়েছি অন্য কোনো জমিতে এরকম ফলন হয়নি।”

আরেক কৃষক আব্দুর রাফি বলেন, “হাইব্রিড টিয়া ধানের বীজ পেয়ে এবার প্রথম চাষ করি। এটি এত ফলন দেবে ভাবতেও পারিনি। এই ফলন দেখে আগামীতে এই এলাকার সকল পতিত জমিই চাষের আওতায় আসবে। নিয়মিত সেচের পানি পেলে এখানে তিন ফসল হবে।”

বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় নেত্রকোণার বিভিন্ন এলাকার চাষিরাও উচ্ছ্বসিত। চার দিকে উৎসবের আমেজে এখন চলছে ফসল কাটাই-মাড়াইয়ের কাজ।

খালিয়াজুরীর উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের কৃষক সুকুমার সরকার প্রায় ১০ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন।

তিনি বলেন, “এইবার হাওরে ধানের ফলন খুবই ভালা অইছে। হাইব্রিড একরে ১০০ মণের বেশি পাইছি। ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতটাও আগের থেইক্যা বেশি অইছে। গেছেবার ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ একরে পাইছিলাম ৫৫ মণের মতো। এইবার ৬০ থেইক্যা ৬৫ মণ পাইতাছি।”

ফলন ভালো হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে আরেক চাষি এরশাদ মিয়া বলেন, “বাতে বাতে (সময়মত) বৃষ্টি অইছে, শীত বেশি দিন আছিল না, যতডা প্রয়োজন গরম অতটাই আছিল। আবহাওয়াডা ভালা থাহনে ফলনডা ভালা আইছে।”

এই জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, নেত্রকোণায় সমতল, পাহাড়ি ও হাওর মিলে এবার ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৮৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৭০ শতাংশ ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পুরোটা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোপদীঘি গ্রামের কৃষক রুহুল আমীন বলেন, যদি আবহাওয়া বর্তমানের মতো অনুকূলে থাকে, তবেই সম্পূর্ণ ধান গোলায় তোলা সম্ভব হবে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে লকডাউনে ধান কাটার মজুর সঙ্কট দেখা দিয়েছে অনেক এলাকায়। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন কৃষকদের জন্য এগিয়ে এসেছে।

এবার বন্যা না হলেও বোরো ফসলে ক্ষতির কারণ হয়ে এসেছিল ‘হিট শক’। তাপদহে বিভিন্ন অঞ্চলে ধানে চিটা ধরে যায়।

নেত্রকোণায় এবার হিট শকে ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির প্রায় ৪০ হাজার টন ধানের ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুর বলেন, “তবে ভালো ফলন হওয়ায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।”

কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, “গরম বাতাসজনিত কিছু ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া এ মৌসুমে খুবই ভালো ফলন হয়েছে।”

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরও একই মত প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “হিট শকে ধানের ক্ষতির বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যে দুঃচিন্তা করা হয়েছিল বাস্তবে এমনটা হবে না। আমাদের হিসেবে এক শতাংশের মতো ক্ষতি হতে পারে।

“তারপরও আমরা ক্ষতি দেড় শতাংশ ধরেই হিসেব করছি। এতে দেখা গেছে এক থেকে দুই লাখ মেট্রিক টন ধান কম উৎপাদনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছি। এর বেশি ক্ষতি হবে না।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার মাঠে ফলন ভালো হয়েছে। এই ফসলটি উঠার আগে যদি আর কোনো দুর্যোগের কবলে না পড়ে, তাহলেও গতবারের চেয়ে এবার ফলন বেশি হবে, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কৃষক বিল্লাল মিয়া এবার ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছেন। বাম্পার ফলনে খুশি হলেও ধানের দাম পাওয়ার আশায় আছেন তিনি।

তিনি বলেন, “ধান কাটা কেবল শুরু হয়েছে। আমি ২০ শতাংশ ধান ইতোমধ্যে ঘরে তুলেছি। এবার প্রত্যাশা অনুযায়ি বেশ ভালো ফলন হয়েছে। গতবার ধানের দাম পেয়েছি। এবারও আশা করবো ধানের দাম যেন ভালো পাই।”

[প্রতিবেদন তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন মৌলভীবাজার প্রতিনিধি বিকুল চক্রবর্তী, নেত্রকোণা প্রতিনিধি লাভলু পাল চৌধুরী ও কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি মারুফ আহমেদ]

আরও পড়ুন