সিএমএসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে বড় ছাড়

মহামারীকালে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে এ খাতের উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2020, 07:31 PM
Updated : 21 July 2020, 07:32 PM

মঙ্গলবার এক সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিএমএসএমই খাতের ঋণ খেলাপি করার সময়সীমা অন্য সব খাতের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণেও বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, এখন থেকে সিএমএসএমই খাতের যে কোনো ঋণ ৬ মাস থেকে ১৮ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড মানে শ্রেণিকৃত হবে।

অন্য সব খাতের মতো সিএমএসএমই ঋণও এতদিন তিন থেকে ৯ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে নিম্নমান বিবেচিত হত।

আর এখন থেকে সিএমএসএমই খাতের যে কোনো ঋণ ১৮ থেকে ৩০ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা সন্দেহজনক বা ডাউটফুল হিসেবে বিবেচিত হবে।

এতদিন অন্য সব খাতের মতো এই খাতের ঋণও ৯ থেকে ১২ মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে তা সন্দেহজনক মানে শ্রেণিকৃত করা হত।

এছাড়া এখন থেকে সিএমএসএমই খাতের ঋণ ৩০ মাসের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে খেলাপি বিবেচিত হবে।

এতদিন অন্যান্য খাতের মতো সিএমএসএমই ঋণও ১২ মাসের বেশি অনাদায়ী থাকলে তা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হত।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে নিয়মিত ঋণের বাইরে ঋণ শ্রেণিকরণের (খেলাপি ঋণ) তিনটি পর্যায় রয়েছে। এসব শ্রেণীমান বিবেচনায় প্রতিটি ব্যাংকের মুনাফা থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি রেখে কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারে না।

ব্যাংকগুলোকে সিএমইসএমই খাতে ঋণ দিতে আগ্রহী করতে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

মঙ্গলবারের সার্কুলারের মাধ্যমে ঋণ খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি সিএমএসএমই খাতের নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণেও বড় ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মহামারীতে এমন ছোট উদ্যোক্তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন (ফাইল ছবি)

বেশ কিছুদিন ধরেই সিএমএসএমই খাতের নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে দশমিক ২৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অন্য সব খাতের নিয়মিত ঋণের বিপরীতে যেখানে রাখতে হয় ১ শতাংশ।

এখন থেকে সিএমএসএমই খাতের সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হবে। আগে অন্য সব খাতের মতো এক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হত।

এখন থেকে সিএমএসএমই খাতের সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হবে ২০ শতাংশ। এতদিন যেখানে ৫০ শতাংশ রাখতে হত।

তবে মন্দ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে বর্তমানের মতোই শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে বলে সার্কুলারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর মহামারীর প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধারে গত মার্চ থেকে কয়েক দফায় সরকার এক লাখ চার হাজার কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে।

এরমধ্যে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং সিএমএসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।

প্রণোদনার এই অর্থ ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ হিসেবে পাবেন শিল্পোদ্যোক্তারা, ওই ঋণের সুদের অর্ধেক সরকার পরিশোধ করবে।

প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পর ব্যাংকগুলো অর্থ সঙ্কটের কথা তুললে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তহবিল যোগানের উদ্যোগও নেওয়া হয়।

এরপরও ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো ধীর গতিতে চলছে বলে এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন অভিযোগ করে আসছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে বার বার।

ব্যাংকগুলো বড় উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে আগ্রহী হলেও সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে একদমই আগ্রহ প্রকাশ করছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই নাগাদ ব্যাংকগুলো সিএমএসএমইতে মাত্র ২০৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে।

মহামারী থেকে অর্থনীতি উদ্ধারে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ছাড়ে ব্যাংকগুলোর গড়িমসি দেখে সময়ও বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় এবং ঋণ খেলাপি করার সময়সীমা বাড়ানোয় ব্যাংকগুলো এখন হয়ত সিএমএসএমইতে খাতে ঋণ দিতে এগিয়ে আসবে।”

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর একইসঙ্গে বলেন, “কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কিন্তু ভালো ছিল না। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আরও খারাপ হয়েছে। চলতি বছরে অধিকাংশ ব্যাংক মুনাফা করতে পারবে না। কিছু ব্যাংক লাভ করলেও খুব সামান্য হবে। এই অবস্থায় তারা কতটা ঋণ দিতে পারবে সেটাই এখন বড় বিষয়।”

ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিএমএসএমই খাত। এই খাত ঘুরে না দাঁড়ালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না।

“যে করেই হোক এ খাতের ঋণ প্রবাহ বাড়াতেই হবে। আর এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও কোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন হলে সেটা নিতে হবে। দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই নিতে হবে।”