এই সঙ্কটে পাওনার আশায় চিনিকলের আখচাষিরা

আখ মাড়াই মৌসুম শেষ হয়েছে অন্তত দেড় মাস আগে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর কাছে আখের দাম এখনও পাননি চাষিরা, যা আড়াইশ’ কোটি টাকার মতো।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2020, 05:57 PM
Updated : 21 April 2020, 05:57 PM

করোনাভাইরাস সঙ্কটের এই সময়ে সরকারের কাছে শিগগির আখের দাম পরিশোধের দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএফআইসি) অধীনে পরিচালিত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে সবগুলোই লোকসানি প্রতিষ্ঠান।

এগুলোতে প্রতিকেজি চিনির উৎপাদন খরচ চিনিকলভেদে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অথচ বেসরকারি পর্যায়ে চিনির দাম কেজি ৫২ ‍টাকা থেকে ৬০ টাকা।

এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসানে ডুবে থাকা চিনিকলগুলো চাষির দেনা পরিশোধে সরকারের মুখ চেয়ে আছে।

অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলে আখ মাড়াই শুরু হয়। আখ মজুদ থাকা সাপেক্ষে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে এই মাড়াই। গত দুই বছর ধরে চাষিরা প্রতিমণ ১৪০ টাকা দরে চিনিকলগুলোতে আখ সরবরাহ করেছে।

বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান বাদশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৫টি চিনিকলের কাছে আড়াইশ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ কৃষকের।

“করোনাভাইরাসের এই সময়ে সবদিকের আয়-ইনকাম যখন থমকে গেছে সেই সময়ে কৃষকরা সরকারের কাছে এই বকেয়া ফেরত পাওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।”

শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আখচাষিরা (ফাইল ছবি)

তিনি বলেন, “গতবছর মন্ত্রণালয়ে মিটিংয়ে বলা হয়েছিল, এক হাতে আখ এক হাতে টাকা দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী মাত্র এক কিস্তি এভাবে টাকা দেওয়া হয়েছিল। এর পর থেকেই বকেয়া পড়ে আছে।

“একটি মৌসুম গিয়ে আরেকটি চলে আসছে। এখন নতুন করে মাঠে বিনিয়োগ করার মতো পয়সাও কৃষকের হাতে নেই।”

পাবনা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদ জানান, তার কলে চাষিদের ২০ কোটি টাকার মতো বকেয়া রয়েছে।

এজন্য চিনি বিক্রি করতে না পারাকে কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, “চিনি বিক্রি করেই চলার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সেভাবে হচ্ছে না। কারণ এখানে উৎপাদন সক্ষমতা হচ্ছে ১৫ হাজার টন। কিন্তু মিল পূর্ণ সক্ষমতায় আর উৎপাদন করতে পারছে না। এবছর ১০ হাজার টন উৎপাদন করা গেছে।

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

“কেবল চিনি বিক্রি করে আর আখের টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন থেকে বরাদ্দ পাওয়ার পরই আখের টাকা পরিশোধ করা হয়।”

“গত ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত যারা আখ দিয়েছে, সেই পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করতে পেরেছিলাম। এর পরে হেড অফিস থেকে আর টাকা পয়সা পাইনি,” বলেন তিনি।

নাটোর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএফএম জিয়াউল ফারুক বলেন, আখচাষিদের ২৬ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। চিনি বিক্রি করা যাচ্ছে না বলে টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না।

“এর আগে চিনি বিক্রি করে ৩০ কোটি টাকার মতো পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি যে চিনি আছে তা বিক্রি করা হয়ে গেলে বকেয়া দিয়ে দেওয়া যাবে। অন্যথায় সরকারের সঙ্গে একটা দেন-দরবার করা হচ্ছে। সেটা সফল হলেও টাকা আসবে এবং টাকা দিয়ে দেওয়া হবে।”

কুষ্টিয়া চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, তা ওখানে আখচাষিরা প্রায় ১০ কোটি টাকা পাবেন।

“বর্তমানে ৩ হাজার ৪৭৬ টন চিনি মজুদ রয়েছে। আমরা চিনি বিক্রির খুব চেষ্টা করতেছি। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতির কারণে বিক্রি হচ্ছে না। গত ২৫ মার্চ থেকে চিনি বিক্রির আদেশ পেয়েছি কিন্তু বিক্রি করতে পারিনি।”

তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কর্মচারী বেতনও বাকি রয়েছে। চলতি বছরের উৎপাদন খরচ জুনের আগে পাওয়া যাবে না।

চাষিদের পাওনা পরিশোধের বিষয়ে বিএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কৃষকের পাওনা পরিশোধ করতে আমরা সরকারের কাছে একটা প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। আমরা সরকারের কাছ থেকে টাকা-পয়সা পেলে তা দিয়ে কৃষকের পাওনা পরিশোধ করব।”

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো হচ্ছে- পঞ্চগড় চিনিকল, ঠাকুরগাঁও চিনিকল, সেতাবগঞ্জ চিনিকল, শ্যামপুর চিনিকল, রংপুর চিনিকল, জয়পুরহাট চিনিকল, রাজশাহী চিনিকল, নাটোর চিনিকল, নর্থবেঙ্গল চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল, মোবারকগঞ্জ চিনিকল, পাবনা চিনিকল, ফরিদপুর চিনিকল, জিলবাংলা চিনিকল ও কেরু অ্যান্ড কোং।

এসব মিলের অধিকাংশ চিনিই সেনা বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়। এর বাইরে অনেক সময় ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা টিসিবির কাছে যায় এসব চিনি।

রাষ্ট্রীয় ১৫টা সুগার মিল দেশীয় আখের ওপর ভর করে চলছে। এর বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে মেঘনা, সিটি গ্রুপসহ ছোট বড় ছয়টি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করে থাকে। বাজারে বেসরকারি কোম্পানিগুলো প্রতিকেজি ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকার মধ্যে খুচরায় চিনি বিক্রি করে থাকে। প্রতিকেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হয় রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর চিনি।

প্রতিবছর বিভিন্ন জেলায় তিন লাখ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়ে থাকে। এই চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।