আর্থিক খাতের ‘বিশৃঙ্খলায় বিপদের’ শঙ্কা বিশ্লেষকদের

দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির তিন বিশ্লেষক।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2020, 05:25 PM
Updated : 19 Jan 2020, 05:44 PM

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনও এতো ঋণ সরকারকে নিতে হয়নি।

এর মধ্যে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে রোববার মুদ্রানীতিতেও পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ২৪.৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭.৭ শতাংশ করা হয়েছে।

জায়েদ বখত

মুদ্রানীতিতে এই পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু সরকার এই ছয় মাসেই প্রচুর ঋণ নিয়ে ফেলেছে, ভবিষ্যতেও ঋণ নিতে হবে, সে কারণেই সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি অনেক বাড়িয়ে নিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”

আয়ের তুলনায় সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য সব সময়ই বেশি থাকে। সেজন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত থেকে অর্থ ধার করতে হয়। কোন খাত থেকে কত টাকা ধার করতে হবে, তার একটি লক্ষ্যমাত্রা অর্থবছরের শুরুতেই ঠিক করে নেয় সরকার, বাজেটে তার ঘোষণা থাকে। এর ব্যত্যয় হলে সরকারের নগদ অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার সংস্থান করতে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। ঘাটতির ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার (অনুদান বাদে) একটি অংশই সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার করে পূরণ করছে।

এবার বাজেটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকার ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিতে চেয়েছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাসেই ৪৮ হাজার ১৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়ে গেছে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রাজস্ব আদায় কম, সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও নেই। সরকারের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। দেশ চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে।”

দেশের ব্যাংক খাতে দুরবস্থা চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকায় উঠেছে।

গত নভেম্বর শেষে সেরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭৩ শতাংশ। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৬ শতাংশ। আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ।

সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের টাকার টান পড়ে বেশি। কিন্তু এবার শুরু থেকেই অর্থ সঙ্কটে রয়েছে সরকার।

সার্বিক এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আজিজুল ইসলাম বলেন, “সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে সঙ্কট বাড়ছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে বলা যায়। পুরো আর্থিক খাত একটা উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”

এ অবস্থায় চলতি অর্থবছর সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কীভাবে সম্ভব হবে- সে বিষয়ে সন্দিহান অর্থনীতির এই গবেষক।

আর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন ‘খুবই খারাপ’।

“রাজস্ব আদায়ের অবস্থা ভালো না। যেখানে ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা, সেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি ছয় মাসে অবস্থার উন্নতি হবে- তেমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।”

রাজস্ব আদায় কম হওয়ার পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়ায় সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হচ্ছে বলে মনে করছেন আহসান মনসুর।

ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ধার করার রেকর্ডটি ছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর ধারের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।

সেই রেকর্ড এবার ভেঙে গেছে ছয় মাস পার হওয়ার আগেই। ছয় মাসের ধারসহ ব্যাংক ব্যবস্থার কাছে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ১১১ কোটি টাকা। অথচ গত জুনেও এ পরিমাণ ১ লাখ ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ছিল।

আহসান এইচ মনসুরের বিশ্লেষণ বলছে, সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে সোয়া লাখ কোটিতে গিয়েও ঠেকতে পারে।

“সেক্ষেত্রে বিস্ময়কর যে তথ্য সবার সামনে চলে আসবে, সেটি হল সরকারের ব্যাংক ঋণের যে স্থিতি অর্থবছরের শুরুতে ছিল, এক বছরেই তার চেয়ে বেশি অংকের ঋণ নেওয়া হয়ে যাবে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এই ‘বিশৃঙ্খলা’ দেশের অর্থনীতিতে বড় সঙ্কট ডেকে আনতে পারে, কেননা এর সঙ্গে বিনিয়োগ সরাসরি সম্পর্কিত।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমতে কমতে সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে। সরকার এই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই বিপুল অংকের টাকা নিয়ে নিলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোত্থেকে?  তাতে বিনিয়োগে যে খরা চলছে সেটা আরও খারাপ হবে। অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।”

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। নানা তৎপরতা চালিয়েও খেলাপি ঋণের আদায় বাড়ছে না। এর মধ্যে এপ্রিল থেকে ঋণে নয় শতাংশ এবং আমানতে ছয় শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

“এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমানত না বাড়লে ব্যাংকগুলো বাড়তি ঋণ বিতরণ করবে কীভাবে? সরকার বিশাল অংকের ঋণ নিয়ে নিচ্ছে; আমানত নেই। সেরকারি খাতে ঋণ যাবে কোত্থেকে? সে কারণেই বলছি, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”