পুরো বছরের ঋণ ৫ মাসেই

ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে যে ঋণ নেওয়ার কথা ছিল তার প্রায় পুরোটা পাঁচ মাসেই নিয়ে ফেলেছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Dec 2019, 04:27 PM
Updated : 7 Feb 2020, 04:14 PM

আর এই ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।তিনি বলেছেন, আর্থিক খাতের যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণেই এবার এমন পরিস্থিতি হচ্ছে।কমছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ।

“রাজস্ব আদায় না বাড়লে এই ঝুঁকি অঅরও বাড়বে।”

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, পাঁচ মাস নয় দিনেই (১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে সরকার। এরমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।

অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে ( ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন) ব্যাংক থেকে সরকারের যে টাকা ধার করার কথা ছিল তার পুরোটাই পাঁচ মাসে নিয়ে ফেলেছে।

সবমিলিয়ে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে।

আহসান এইচ মনসুর (ফাইল ছবি)

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, সরকার চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরেছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। চার মাসে (অক্টোবর) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ শতাংশের মতো।

“গতবার প্রচুর বিক্রি হওয়ায় সঞ্চয়পত্র থেকে ধার করেছিল।এবার বিক্রি কম হওয়ায় সেখান থেকে নিতে পারছে না।”

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও এ বাস্তবতার কথা স্বীকার করেছেন।বুধবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, “এতোদিন প্রথমে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হত। পরে ঘাটতি থাকলে ব্যাংক থেকে নেওয়া হত। কিন্তু এবার বিপরীত প্রক্রিয়া করা হয়েছে। প্রথমে ব্যাংক থেকে নেওয়া হচ্ছে; আর ব্যাংক থেকে তো সরকার নেবেই। রাজস্ব আয় নিয়ে সমতা আনতে পারিনি, চাহিদা মোতাবেক না আসায় ঘাটতি বাজেট করতে হয়, ঘাটতি যেটা আছে এজন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।”

“আমরা আগে টাকা দুই সোর্স থেকে নিতাম। মেইন সোর্স ছিল সেভিংস (সঞ্চয়পত্র), তারপর ফিনান্সিয়াল মার্কেট। কিন্তু কড়াকড়ি আরোপ করায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। কাদের জন্য এ উদ্যেগ গ্রহণ করা হয়েছিল? প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য, তাদের বেনিফিটে হাত দেব না।”

“কিন্তু এদের নাম করে ধনী সম্প্রদায় টাকা নিয়ে আমাদের যদি বিপদে ফেলে সেটা তো হতে পারে না। এটা তো লোন এটার উপর ইন্টারেস্ট দিতে হয়। কেন দেব ইন্টারেষ্ট, এরা ব্যবসা করে বড়লোক হচ্ছে।আমার সেভিংস এ ইনভেস্ট করে বেশী বেশী পাচ্ছে ইন্টারেস্ট পাচ্ছে; আর আমাদেরকে ঠকাচ্ছে। আমরা যাদের জন্য দিয়েছিলাম তাদের জন্য অব্যাহত রাখবো।”

ফাইল ছবি

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য ঘেটে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৫ হাজার ৫১২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় তিন গুণেরও বেশি; ১৭ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।

তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। অগাস্টে তা নেমে আসে ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকায়।

সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৯৮৬ কোটি ও ৮২৩ কোটি টাকা।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৮৬ হাজার ৭২০ কোটি ২৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৭৭৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৯৪৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

তার আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।

এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

কড়াকড়ি এবং কর বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হবে ধরে নিয়ে এবারের বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য কম ধরেছে সরকার।চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্য ধরা আছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বিক্রি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় এ খাত থেকে ঋণ পাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহনের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ।যা ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর সবচেয়ে কম।ওই সময় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।

২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ বেশ বাড়ছিল।২০১৭ সালের নভেম্বরে এই হার ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশে উঠেছিল।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় বড় প্রকল্পে সরকারের খরচ বাড়ায় ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

“সরকার বড় অংকের ঋণ নিয়ে নেওয়ায় বেসরকারি খাত বঞ্চিত হচ্ছে।”