বাড়ছে সরকারের ঋণ, পাচ্ছে না বেসরকারি খাত

সরকারের ব্যাংক ঋণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের ভাটা পড়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2019, 04:02 PM
Updated : 13 Nov 2019, 04:12 PM

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার।কিন্তু চার মাসেই ৩৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে।

অর্থাৎ পুরো বছরের লক্ষ্যের চার ভাগের তিন ভাগ চার মাসেই নিয়ে ফেলেছে।

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।

আর সরকারি ঋণের এই চাপে বেসরকারি খাতের ঋণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ৩১ অক্টোবর শেষে ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।

এরমধ্যে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই (জুলাই-অক্টোবর) নিয়েছে ৩৩ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকেই নেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৬ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।

অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। মুনাফা কমায় নিরাপদ এই বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিনিয়োগকারীরা।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে সবমিলিয়ে ১১ হাজার ৩০৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।

এরমধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে সাত হাজার ৬৪৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

এ হিসাবেই এই দুই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে নিট সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ ছিল নয় হাজার ৫৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

কড়াকড়ি এবং কর বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হবে ধরে নিয়ে এবারের বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য কম ধরেছে সরকার।চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্য ধরা আছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বিক্রি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় এ খাত থেকে ঋণ পাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহনের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

আর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম ১৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজস্ব আদায় কম।কড়াকড়ি এবং কর বাড়ানোর ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও অনেক কমে গেছে। তাই খরচ মেটাতে সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।”

রাজস্ব আদায় না বাড়লে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

“সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাত ঋণ কম পাবে। বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ।যা ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর সবচেয়ে কম।ওই সময় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।

২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বেসরকারি খাতের ঋণ বেশ বাড়ছিল।২০১৭ সালের নভেম্বরে এই হার ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশে উঠেছিল।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় বড় প্রকল্পে সরকারের খরচ বাড়ায় ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।

চলতি অর্থবছর তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।গত অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা।আশানুরূপ আদায় না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়; যদিও শেষ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ১৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকার নিয়েছিল মাত্র ৯২৬ কোটি টাকা।২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল পরিশোধ করেছিল তার চেয়ে ১৮ হাজার ২৯ কোটি টাকা বেশি।

তার আগের অর্থবছরে নিয়েছিল মাত্র ৪ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা।আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর সরকারের ঋণ কমেছিল ৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়।

এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’  হিসেবে গণ্য করা হয়।