কর দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ চাইলেন নাগরিকরা

দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও এর মধ্যে ৪৫ লাখের বেশি মানুষের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে। তবে সরকারের হিসাবে, তাদের মধ্যে মাত্র অর্ধেকের মতো আয়কর দেন।

জাফর আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2019, 08:14 AM
Updated : 20 Nov 2019, 08:14 AM

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি অনুপাতে কর রাজস্ব আদায়ের হার সবচেয়ে কম, মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ; সবচেয়ে বেশি নেপালের, ২৩ শতাংশ। সেখানে উন্নত বিশ্বে এই হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে।

চলতি বছর বাজেটে সরকার আগামী দুই বছরের মধ্যে জিডিপি রাজস্বের অনুপাত ১০ থেকে ১৪ শতাংশে উন্নীত করার প্রত্যাশার কথা শুনিয়েছে।

এজন্য কয়েকবছর ধরে আয়কর হার না বাড়িয়ে বেশি মানুষকে করের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের; আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত আয়কর মেলার আয়োজন করলেও আশানুরূপ ফল মিলছে না।

এবারও চলছে দেশজুড়ে এক সপ্তাহের আয়কর মেলা; শেষ হচ্ছে বৃহস্পতিবার। আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও মানুষের অনীহা নিয়ে কথা হয় আগের দিন মেলায় অংশ নেওয়া নাগরিকদের সঙ্গে।

তারা বলছেন, নাগরিকদের আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে হলে সরকারের ব্যয়ের স্বচ্ছতা, আর্থিক খাতে সুশাসন ও সর্বোপরি নাগরিক সেবা নিশ্চিত করে কর দেওয়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা দিদারুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জনগণ যদি মনে করে সরকার তাদের কথা চিন্তা করে না, নিজেদের বঞ্চিত মনে করে তাহলে তারা কর দিতে আগ্রহী হবে না।

পুনঃতফসিলিকরণের নামে সরকার যেভাবে বারবার ঋণখেলাপিদের জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাঁচারের সুযোগ করে দিচ্ছে তাতে মানুষ কর দিতে আগ্রহ কেন পাবেন, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি।

“সাধারণ মানুষ যখন মনে করবেন যে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তখন দেশের উন্নয়নে তার শিহরণ জাগবে না। সরকারের শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে লুটপাট করে পাচারকারী কেউ যখন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পান তখন মানুষ নিজেকে বঞ্চিত ভাবতেই পারেন।”

তিনি বলেন, “দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। জিডিপির বিপরীতে রাজস্ব আদায় যে নগন্য জানলে মানুষ নিজেই দেশ চলার জন্য অর্থের যোগান দেবে। কিন্তু তার আগে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।”

কর দিতে উদ্বুদ্ধ করতে নাগরিকদের প্রাপ্য সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাড়তি প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল দিদার।

“সরকারকে এমন আচরণ করতে হবে, যাতে দেশের প্রত্যেকটা মানুষ মনে করে দেশটা আমার। এজন্য সরকার কিছু পদক্ষেপও নিতে পারে। যেমন- ঈদে-পার্বনে মানুষ যখন গ্রামের বাড়িতে যায় তখন ট্রেন, বাস কিম্বা লঞ্চের টিকেটে সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা ভর্তুকি বা ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।”

মেলায় শেষ বিকেলে কর দিতে আসা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরীজীবি নাজির হোসেন বলেন, জনগণ যে কর দিচ্ছে সরকার তা যথাযথ ও স্বচ্ছভাবে ব্যয় করতে হবে।

“সরকার যখন জনগণের অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারবে, তখন সাধারণ মানুষই দেশের প্রয়োজন বিবেচনা করতে শিখবে, কর দিতে উদ্বুদ্ধ।”

আর বেশি নাগরিকদে করের আওতায় আনতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা রকম দাপ্তরিক কাজে জাতীয় পরিচয়পত্রের মতো টিআইএন সার্টিফিকেট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন তিনি।

সত্তরোর্ধ্ব সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আব্দুস শুকুর বলেন, “এদেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ কর দিতে সক্ষম।বেশিরভাগ মানুষ কর দিতেও চাও। কিন্তু বিদ্যমান পরিবেশ দিয়ে সরকার মানুষের কাছ থেকে কর নিতে পারছে না।

“কী করলে সাধারণ মানুষ নিজে থেকে এসে আয়কর দেবে তা সরকারকেই বুঝে বের করতে হবে।”

মেলা আয়কর বিবরণী দাখিল করতে আসা ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী সৈয়দ বেলায়েত হোসেন বললেন রাজস্ব কর্মকর্তাদের কাছে এসে হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়ে জনমনে ভীতির কথা।

মানুষ কর দিতে চাইলেও শুল্ক কর্মকর্তাদের হয়রানির ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী শুল্ক ফাঁকি দেন বলে তিনি মনে করেন।

“দেখুন সরকার প্রচার করেছে যে মেলায় এসে কর দিলে কাউকে কিছু প্রশ্ন করা হবে না। দেশের জন্য বিনা প্রশ্নে কর দেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় সাধারণ মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের টাকা সরকারকে দিয়ে যাচ্ছে।

“এসব করদাতারা দেশকে কিছু দিতে পেরে গৌরব বোধ করছেন বলে আমি মনে করি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এভাবে কৌশলে দেশপ্রেম ঢুকিয়ে দিতে পারলে দেশের বেশিরভাগ মানুষই কর দিবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

মঙ্গলবার পর্যন্ত মেলার ছয় দিনে মোট কর আদায় হয়েছে ২ হাজার ১৬ কোটি ৪৫ লাখ ২১ হাজার ১২০ টাকা। ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৯১০ জন করদাতা রিটার্ন জমা দিয়েছেন। কর সংক্রান্ত সেবা নিয়েছেন ১৫ লাখ ১২ হাজার ৫৯২ জন। এই ছয় দিনে নতুন টিআইএন নিয়েছেন ২৬ হাজার ৮৩১ জন।