গার্মেন্ট শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণে স্থায়ী তহবিলের পরামর্শ

রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা বিভিন্ন পক্ষের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেলেও দেশের বৃহৎ এই খাতে বড় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা এখনও গড়ে উঠেনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2019, 07:29 PM
Updated : 16 April 2019, 07:47 PM

ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে এখনই একটি কর্তৃপক্ষ ও স্থায়ী তহবিল গঠনের পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড।

সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ছয় বছর পর মঙ্গলবার পোশাক খাতের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে করা এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এই পরামর্শ দেন সংস্থার অন্যতম ব্যবস্থাপক নুজহাত জাবিন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আটতলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও হাজারখানেক গার্মেন্ট শ্রমিককে।

এরপর পোশাক খাতে কতটা সংস্কার হয়েছে এবং রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের জীবন কেমন চলছে সে বিষয়গুলোই তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠানে নুজহাত জাবিন দেখান, ওই দুর্ঘটনার পর শ্রম আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার এনেছে সরকার। অ্যাকর্ড-এ্যালায়েন্সের মাধ্যমে প্রচলন হওয়া কারখানার অগ্নিনিরাপত্তা ও শ্রম নিরাপত্তা যাচাইয়ের দায়িত্ব পেয়েছে সরকার গঠিত আরসিসি বা রিমেডিয়েশন অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন সেল। এছাড়া গঠন করা হয়েছে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, শ্রমিক নিরাপত্তা কমিটিসহ অন্যান্য রক্ষাকবচ।

রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের ২০০ শ্রমিকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা গেছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ভীতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন অধিকাংশ শ্রমিক। তবে বেশ কয়েকজন এখনও ভবনের সিঁড়ি কিংবা উঁচু দালান দেখে ভয় পান।

অর্ধেক শ্রমিক পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। বিক্রয়কর্মী, দর্জির কাজ, কৃষি কাজ, দিনমজুর হিসাবে কাজ করছেন তারা। মাসে আয় করছেন ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা।

গত ১৮ বছরে এই খাতের সমগ্রিক পরিবর্তন চিত্রে শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার প্রমাণও তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে।

বলা হয়, ২০০০ সালে মোট রপ্তানির ৭৫ ভাগ জুড়ে ছিল পোশাক খাত। ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের বিপরীতে পোশাক খাতে ২০ লাখ শ্রমিক কাজ করতেন। কিন্তু এখন ২০১৮ সালে রপ্তানি প্রায় সাতগুণ বেড়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। মোট দেশীয় রপ্তানি বাজারের ৮৩ শতাংশ শেয়ার পোশাক রপ্তানি থেকে। অথচ এখন শ্রমিক বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০ লাখ।

“এই থেকে বোঝা যায় অটোমেশন ও অন্যান্য কারণে পোশাক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা কমছে।”

পোশাক খাতে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য না থাকলেও পদ বৈষম্য এখন স্পষ্ট বলে মন্তব্য করেন নুজহাত জাবিন।

সিপিডির এক জরিপে দেখা গেছে, ব্যবস্থাপক পদে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং মানবসম্পদ বিভাগে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ নারী রয়েছে । অটোমেশন বা প্রযুক্তিপণ্যের সংযোগের কারণে পোশাক খাতের শ্রম পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রণ কমে যাচ্ছে। নারীরা ৩৫ থেকে ৪০ বছর পর আর পোশাকখাতে শ্রম দিতে পারেন না।

বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, পোশাক খাতে সামাজিক সুরক্ষা না থাকার কারণে নারীরা পিছিয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি বাসা-বাড়িতে তাদের কিছু দায়িত্ব থাকায় তারা কারখানায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে পারেন না। তাই তাদের সুপারভাইজার হওয়াও হয়ে উঠে না।

সমস্যার সমাধানে নারীদের জন্য ডরমিটরি ও পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেন এই গবেষক।

সিপিডির পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের অন্যতম কারণ হচ্ছে সময় মতো বেতন-বোনাস না দেওয়া। কীভাবে ক্রেতাদের কাছ থেকে সঠিক সময়ে টাকা আদায় করে তা শ্রমিকদের মাঝে বণ্টন করা যাবে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব কারখানাগুলোর।

ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এসট্রোপ পিটারসন বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। এখন সোশ্যাল ডায়ালগ ও ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বাকি সমস্যাগুলোর সমাধান করা যেতে পারে।

অনুষ্ঠানে অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, “রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের দুর্ঘটনা আর যে ঘটবে না তা কেউ বলতে পারে না। তাই শ্রম মন্ত্রণালয়ের উচিত ক্ষতিপূরণের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করা।

“আর ক্রেতারাও পণ্যের দাম প্রয়োজনের আলোকে বাড়াচ্ছেন না। পোশাকের দামে একটা স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন।”

শ্রমিকদের পক্ষে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।