অর্থনীতিতে ‘স্বস্তি’ নিয়ে দায়িত্ব নিচ্ছে নতুন সরকার

আমদানি কমায় স্বস্তি ফিরেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, ফের বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন; পাশাপাশি রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধিও আশা জাগাচ্ছে।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2019, 06:30 PM
Updated : 5 Jan 2019, 06:42 PM

গত বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার (ঋণপত্র) পরিমাণ যেখানে ৯১ শতাংশ বেড়েছিল; চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সেই এলসি উল্টো পথে এসে ৩১ শতাংশ কমেছে। 

আমদানির চাপে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে যে টান পড়েছিল তা কেটে গেছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) দীর্ঘদিনের বড় ঘাটতিও কমতে শুরু করেছে।

এই অবস্থায় নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ বেশ ‘স্বস্তিদায়ক’ হবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেভাবে আমদানি বাড়ছিল সেটা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটত। বছরের শেষ ভাগে এসে আমদানি কমায় সে ঝুঁকি কেটে গেছে। আমদানি কমায় ব্যালান্স অফ পেমেন্টে ঘাটতিও কমে আসবে।”

আহসান এইচ মনসুর

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের বিচারে, নির্বাচনের বছর ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘ভালোই’ গেছে।

“নির্বাচনের বছর ঘিরে এক ধরনের উদ্বেগ ছিল, উৎকণ্ঠা ছিল। ফের অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধ জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয় কি না সে শঙ্কা ছিল। কিন্তু সব উৎরে ২০১৮ সাল ভালোভাবেই শেষ হয়েছে।”

বছরের একেবারে শেষে এসে ৩০ ডিসেম্বর যে ভোট হয়েছে, তাতে আরও পাঁচ বছর দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছে গত এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। ‘সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রা’ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ইশতেহারের মূল কথা। টানা তৃতীয় বার এবং দেশের চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আমদানিতে উদ্বেগ ছাড়া বিদায়ী ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো ছিল ইতিবাচক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছিল ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের এই চার মাসে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ।

সর্বশেষ অক্টোবর মাসের আমদানির পরিমাণ আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে মাত্র ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের অক্টোবরে বেড়েছিল ৩০ শতাংশের মতো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি ব্যয়ের অক্টোবর পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করলেও এলসি খোলার তথ্য প্রকাশ করেছে নভেম্বর পর্যন্ত।

সে তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে নানা ধরনের পণ্য আমদানির জন্য ২ হাজার ৪৪৭ কোটি (২৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে।

গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-নভেম্বর) এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৭৫ কোটি ১০ লাখ (৩৫.৭৫ বিলিয়ন) ডলার।

সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ৩১ শতাংশ।

রিজার্ভ আবার ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

ওই মাসেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছে: ওটাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ।

এরপর আমদানি বাড়ায় রিজার্ভ কমতে শুরু করে। গত বছরের নভেম্বরে সেই রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে, যদিও ২০১৬ সালের পর রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের নীচে নামেনি।

আমদানি কমায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ফের বাড়তে শুরু করেছে। গত ৩ জানুয়ারি রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধির হারও আছে ইতিবাচক ধারায়। গত অর্থবছর রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর)) রেমিটেন্স বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি।

তৈরি পোশাকের ওপর ভর করে রপ্তানি আয় লক্ষ্যের চেয়ে বেশি হয়েছে

গত অর্থবছর রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আর এ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সে গতি আরও বেড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ।

অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি আছে সহনীয় অবস্থায়। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

লেনদেন ভারসাম্যেও উদ্বেগ কমছে

বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বড় ঘাটতি নিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষ করেছিল বাংলাদেশ। ওই ঘাটতি ছিল এক বছরে বালাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঘাটতি।

আমদানি কমায় লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিও কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার।

গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটিতর পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ, ৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার।