আমনের দামে কৃষক খুশি হলেও দুশ্চিন্তা নগরে

আমন ধান উঠলে চালের দাম আরও কমবে বলে আশা করা হলেও নতুন চালে দাম কমেনি ঢাকার বাজারে, উল্টো দাম কিছুটা বাড়ার কথা জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2017, 04:32 AM
Updated : 9 Dec 2017, 04:36 AM

বিগত বছরগুলোর তুলনায় ধানে বাড়তি দাম পাওয়ায় কৃষকরা খুশির কথা বললেও বাঙালির প্রধান এই খাদ্যপণের দাম আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

মিরপুর-১ নম্বর বাজারে চালের পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন হারুন বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত বছর এই সময় আমনের নতুন চাল পাইকারিতে প্রতিকেজি ৩২ টাকা থেকে ৩৪ টাকার মধ্যে ছিল। এবার সেই চাল ৪০ থেকে ৪১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন আমন ধান থেকে উৎপন্ন মোটা চালের দাম ৫০ কেজির বস্তা দুই হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২০৫০-২০৭০ টাকায় পৌঁছেছে।

 “মোটা চালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য চালও বস্তায় ৫০ টাকা করে বেড়েছে গত এক সপ্তাহে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সব ধরনের চালে ৫০ কেজির বস্তায় চারশ টাকা করে বেড়েছে।”

চালের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা জানিয়ে ঢাকার বাড্ডার সাঁতারকুল রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক বিপ্লব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত কয়েক মাস ধরে চালের দাম যখন বাড়ছিল, তখন আমরা মনে করছিলাম, আমন ধান উঠলে অন্য সব বারের মতো এবারও চালের দাম কমবে। কিন্তু সেটা হয়নি।

“আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মৌসুম শেষে ধান-চালের দাম একধাপ বাড়ে। এবার আমনের মৌসুমে কৃষক ধানের ভালো দাম পেলেও বাজারে চালের দাম কমেনি। মৌসুম শেষে চালের দাম আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।”

অধিক শুল্ক হারের কারণে আমদানি বন্ধ থাকা, বোরো মৌসুমে হাওরে বন্যায় ফসলহানি, মজুদে ঘাটতিসহ নানা কারণে গত কয়েকমাস ধরে (কোরবানির ঈদের পর থেকে) ঊর্ধমুখী চালের দাম। এর মধ্যে মোটা চাল প্রতিকেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা, আর সরু চাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় উঠে।

 এই প্রেক্ষাপটে গত ১৯ সেপ্টেম্বর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক ও আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের পর খুচরায় সরু চাল ৬০ টাকায় এবং মোটা চাল ৪০ টাকায় নামে। নতুন আমন চাল বাজারে এলে দাম আরও কমবে বলে আশার কথা শুনিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।

তবে গত ৩০ নভেম্বর সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে আমনের তিন লাখ টন চাল সংগ্রহের ঘোষণা দেওয়ার পর মিল গেইটেই এখন চালের দাম প্রতিকেজি ৪১ টাকা হয়েছে।

চালের দামের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিঃশ্বাস নগরে

চালকল মালিকরা বলছেন, সরকার চাল কেনার ঘোষণা দেওয়ার আগে নতুন ধানের দাম ছিল মণ প্রতি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। গত মওসুমেও এই দামে বিক্রি হয়েছিল ধান। এখন ধানের মণ ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায় উঠেছে।

ধানের দামে সন্তোষ জানিয়ে বেলায়েত হোসেন নামে নড়াইলের কালিয়ার একজন কৃষক বলেন, “এবার ধানের দামটা ভালো আছে। এবার কিছুটা লাভ হবে।”

ধানের দাম বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন কম হওয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, শেষ বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বন্যায় আমনের ক্ষেত ডুবেছে, এরপরও টিকে থাকা ধানে হয়েছে পোকার আক্রমণ।

নওগাঁ জেলা ‍কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনোজিৎ কুমার মল্লিক জানান, জেলায় দুই লাখ ১০০ হেক্টর জমিতে এবার আমন চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে বন্যায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। তবে যেটুকু টিকে আছে তাতে ফলন ভালো।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃষি কর্মকর্তা মনজুরুল হুদা জানান, বন্যায় জেলায় ৩৮০০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ পুনরায় রোপণও করা হয়েছিল। আবার শেষ মুহূর্তে ভারি বর্ষণের পর কিছু কিছু এলাকায় পোকার আক্রমণও হয়েছিল।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সারাদেশে আমন কাটা শুরু হয়। ডিসেম্বর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৮০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য। 

অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৫-২০১৬ সালে সারা দেশে ৫৫ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছিল। ওই বছর ধানের উৎপাদন ছিল এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টন। পরের বছর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের বিপরীতে ধান হয়েছিল এক কোটি ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন।

চলতি বছর (২০১৭-১৮) সরকারি হিসাবে ৫৭ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমনের চাষাবাদ হলেও বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উৎপাদন কী পরিমাণ হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ সেই তথ্য পাওয়ায যাবে।

জয়পুরহাট জেলার চালকল মালিক ও বাংলাদেশ অটোমেজর হাসকিং রাইসমিল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. লায়েক আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার জেলায় ৯০ শতাংশ ধান কাটা শেষ। সেই হিসাবে এখন আমন ধানের ভরপুর বাজার। তবে ধানের দাম গত বছরের চেয়ে প্রতি মণে প্রায় ২০০ টাকা বেশি।

দামের এই বৃদ্ধিকে ‘ইতিবাচক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার ফলন কম হয়েছে।

ধানের দামে খুশি যশোরের শার্শার কৃষক

“অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা হিসাব করে দেখেছি, ধানের কেজি ২৪ টাকা ধরলে কৃষকরা আমন চাষে লাভজনক পর্যায়ে যাবে। তবে সরকার ৩৯ টাকা করে চালের দাম নির্ধারণের পর ধানের ন্যূনতম বাজার এখন কেজিপ্রতি ২৫ টাকা।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাব রাইস এজেন্সির পরিচালক রনো জানান, গত বছর মওসুমে আমনের দাম ৮০০ টাকা ছিল তার জেলায়। এবার হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে।

নাওগাঁ জেলা চালকল সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, নতুন ওঠা তুলনামূলক সরু জাতের ধান (স্বর্ণা-পাঁচ) এর বাজার বাড়তির দিকে। ১৫ দিন আগে এই ধান প্রতি মণ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে থাকলেও এখন এক হাজার ৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই ধানের দাম ছিল ৭০০ টাকা।

টিসিবির হিসাবে গত বছরের তুলনায় মোটা চালের দাম এখনও ১২ শতাংশ বেশি।

 আর চালকল ও ধান-চাল ব্যবসায়ীদের হিসাবে, গত বছরের তুলনায় আমন ধানের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। 

গত বছর (২০১৬-১৭) ধানের উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ১৯ টাকা ও চালে ২৯ টাকা ধরে ৩৩ টাকা কেজি দরে তিন লাখ টন চাল সংগ্রহ করেছিল সরকার। সেখানে চলতি মওসুমে প্রতি কেজি আমন চালের উৎপাদন ব্যয় ৩৭ টাকা ২ পয়সা ধরে প্রতি কেজি চালের দর ৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এখন মিল গেইটে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৪১ টাকা জানিয়ে চালকল মালিক সমিতির নেতা লায়েক আলী বলেন, “এই দাম আর কমবে না, বরং সামনের দিকে আরও বাড়বে।” 

বাজার স্থিতিশীল রাখতে ধান এখনই চাল আমদানিতে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।