“শিক্ষা নিয়ে স্বপ্নের কথা বলা হয়, আমরা বাজেটে তার প্রতিফলন দেখছি না,” বলেন রাশেদা কে চৌধুরী।
Published : 12 Jun 2024, 09:08 PM
চলতি অর্থবছরের প্রেক্ষাপটে নতুন অর্থবছরের ঘোষিত বাজেট কৌশল ‘প্রত্যাশিত হয়নি’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি বলেছেন, “শিক্ষার সঙ্গে আর্থিক যোগাযোগ আছে। ‘অস্বাভাবিক সময়ে’ একটি ‘গতানুগতিক ধারার’ বাজেট হয়েছে। সব খাতের জন্য একটি প্রস্তুতিমূলক বাজেট হওয়া উচিত ছিল।”
বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ নিয়ে ‘হতাশা’ প্রকাশ করে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা বলেন, “বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন শিক্ষায় বিনিয়োগ, শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। এখন সেটি কি আমরা গত কয়েক বছর থেকে দেখছি? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলছি, কিন্তু শিক্ষায় অগ্রাধিকার দিচ্ছি না। শিক্ষায় বিনিয়োগ এখন বরাদ্দ হয়ে যাচ্ছে।”
ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলে বুধবার বেসরকারি গেবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট সংলাপে অংশ নিয়ে তিনি একথা বলেন।
গত এক দশকে শিক্ষায় বিনিয়োগ কমার কথা জানিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ পরিকল্পনা অর্থবছরের শেষে সংশোধনের সময়ে সবচেয়ে বেশি কাঁটছাট করা হয়। শিক্ষা নিয়ে স্বপ্নের কথা বলা হয়, আমরা বাজেটে তার প্রতিফলন দেখছি না।
“আমাদের তো শিক্ষার্থী বাড়ছে, সেভাবে তো বিনিয়োগ বাড়ছে না। বাজেট সংশোধন করতে গিয়ে অন্যখানে যেখানে ছুড়ি দিয়ে কাটা হয়েছে, সেখানে কোদাল দিয়ে কাটা হয়েছে শিক্ষার বিনিয়োগ। এক অর্থবছরেই কমানো হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা।”
৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
বাজেট প্রস্তাবে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং জিডিপির ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শিক্ষায় মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ৮৯ হাজার ১২ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। খরচ করা টাকার ওই পরিমাণ মোট সংশোধিত বাজেটের ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বাজেট সংলাপে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “২০১৫-১৬ অর্থবছরে থাকা শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ১৪ শতাংশ বিনিয়োগ এখন ২০২৩-২৪ সালে নেমেছে ১০ শতাংশে। একইভাবে কমছে জিডিপির তুলনায়। প্রায় এক দশক আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির ‘১ দশমিক ৭৯ শতাংশ’ ছিল শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। চলতি অর্থবছরে তা নেমেছে ‘১ দশমিক ৪৮ শতাংশে’।”
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়।
ফাহমিদা খাতুন জানান, এলডিসিভূক্ত ৩৮টি দেশের মধ্যে শিক্ষায় সবচেয়ে কম বিনিয়োগ করার দিক দিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। আগামী অর্থবছরেও জিডিপির ‘১ দশমিক ৬৯ শতাংশ’ করা হয়েছে শিক্ষায় বিনিয়োগ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় আগামী অর্থবছরে শিক্ষায় বিনিয়োগ জিডিপির ‘সাড়ে ৩ শতাংশ’ করার কথা।
বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সাযুজ্য দেখছে না সিপিডি
সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সামঞ্জস্য দেখছে না সিপিডি।
নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা বলেন, “আগামী অর্থবছরের বাজেটে এমন প্রত্যাশা ছিল যে, এখনকার সমস্যা কী ও তার সমাধানের কৌশলটা থাকবে। এখনকার সমস্যা হল, আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। তলানিতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, জ্বালানি খাতের দর ও বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ।’’
অথচ বাজেটে তাতে কোনো পদক্ষেপ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। তবে এ দুটি লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন করা ‘সম্ভব নয়’ মন্তব্য করে ফাহমিদা বলেন, “১০ এর কাছাকাছি থাকা মূল্যস্ফীতি এক বছরে কীভাবে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হবে, বিষয়টি অবাক করার মত। মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশ করা খুবই দুর্বিষহ হবে।
“ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ এক দশক ধরে ২৩-২৪ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এক বছরে কীভাবে তা ২৭ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হবে, তা বোধগম্য নয়। এটির জন্য আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ লাগবে বেসরকারি খাতে। এক বছরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হতে হবে ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ।”
ব্যাংকিং খাতকে দুর্বল অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “বাজেটের অভ্যন্তরীণ ঋণের ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ নিতে হবে ব্যাংক থেকে। সরকার যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত কোথা থেকে নিবে, এতে ঋণ সুদের হার বেড়ে যাবে।”
আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্বক ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এমন অবস্থায় আগামী অর্থবছরে আমদানিতে ‘১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি’ ধরা হয়েছে মন্তব্য করে ফাহমিদা বলেন, “আগে তো আমদানিতে ইতিবাচক হতে হবে ঋণাত্বক থেকে। তারপর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখাতে হবে। এটি কীভাবে সম্ভব, যেখানে সরকার আগামী অর্থবছরে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার করতে চাচ্ছে ২৪ বিলিয়ন থেকে।”
একইভাবে সরকার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বর্তমানে ২ শতাংশে থেকে ৮ শতাংশ করার পরিকল্পনা করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো হলেও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমানো হয়েছে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিনিয়োগের লক্ষ্যে সামঞ্জস্য নেই।”
তিনি বলেন, “আগামী বাজেটেই সরকারকে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকার ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১১৪ টাকা করতে চাচ্ছে আগামী অর্থবছর শেষে। যেখানে ডলার সংকট মেটেনি, সেখানে টাকার মান বাড়ানোর পরিকল্পনায় আমি (সরকার) রিজার্ভ বাড়াতে চাচ্ছি, এটি কীভাবে হবে।
“গত দুই বছর থেকে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে পতন হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে গত দুই বছর থেকে যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাতে আমাদের সক্ষমতা কমছে। বছরের পর বছর প্রকল্প শেষ না হওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতি যেমন হচ্ছে, তেমনি প্রকল্পের অর্থনৈতিক ফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে। এমন সময়ে এডিপিতে ব্যয় কমানোর প্রয়োজন ছিল।”
নতুন অর্থবছরের বাজেট নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা তুলে ধরলেও ইতিবাচক দিকগুলোও উল্লেখ করেছে সিপিডি।
নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা বলেন, “আইটিভিত্তিক খাতে শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখায় খাতটির বিকাশ আরও বাড়বে। ফ্র্রিজের কম্প্রেসারের উপর শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করা, কার্বোনেটেড বেভারেজের শুল্ক বাড়ানো, কাজু বাদামের উপর শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা, গুড়ো দুধের উপর থেকে শুল্ক কমানোর মত পদক্ষেপ রয়েছে। এতে অর্থনীতির কিছু বিষয়ে মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।”
কর্মসংস্থান ‘গুরুত্ব পাচ্ছে না’
সিপিডি বাজেট আলোচনায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “গত এক দশক ধরে যে উন্নয়ন কৌশল চলছে, সেখানে কর্মসংস্থান গুরুত্ব পাচ্ছে না। জরিপ বলছে, দেশের ৫৫ শতাংশ তরুণ দেশে ভবিষ্যত দেখছে না। তারা বিদেশ চলে যাচ্ছে। আমাদের শুধু বর্তমানের অবকাঠামো নয়, ভবিষ্যতে দিকেও বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
“ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ডিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মত উদ্দেশ্য বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। এলডিসি উত্তরণে আমরা তৈরি পোশাক খাতে দীর্ঘ মেয়াদে তহবিল চেয়েছিলাম, তা পাইনি। কীভাবে খাতটি সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে। বছরে যদি চার বার গ্যাস ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়, তাহলে কীভাবে পণ্যর দাম সমন্বয় করব। এভাবে তো বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না।”
সিপিডি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের লক্ষ্যের সমালোচনা করলেও বাজেট আলোচনায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, “মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলা করার জন্য আমরা দেশি-বিদেশি সংস্থার পরামর্শ নিচ্ছি। যাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে, তাদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। এজন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়া হচ্ছে। আগের চেয়ে কম বাজেট ঘাটতি করা হয়েছে।
“আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে যাদের সঙ্গে আমরা কাজ করছি, তারা আশাবাদী মূল্যস্ফীতি কমে যাবে। আমরা সঠিক পথে আছি। এখন আমাদের বাস্তবায়নের দিকে শুধু মনোযোগী হতে হবে।”