অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেট দিতে এসে ’স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’র কথা বলেছেন মাহমুদ আলী।
Published : 07 Jun 2024, 02:22 AM
ভোটের বাজেট পেরিয়ে অর্থনীতি মেরামতের পর্বে এসে ব্যয় নিয়ে সংযত থাকলেন নতুন অর্থমন্ত্রী; তার কাছে প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পেল, কিন্তু উত্তরণের সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা মিলল না।
বিগত দিনের ছক অনুসরণ করে আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার যে ব্যয়ের ফর্দ মেলালেন, তাতে সংকট মোচনে উদ্ভাবনী আর সাহসী পদক্ষেপের অভাব দেখতে পেলেন বিশ্লেষকরা।
আ ফ ম মুস্তাফা কামাল তার শেষ বাজেটে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার সংকল্প করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেট দিতে এসে সেই যাত্রা এবার স্বপ্নময় করার কথা বললেন মাহমুদ আলী।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করা তার বাজেটের শিরোনাম ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’।
সরকারের ব্য য়ের পরিকল্পনায় বছর দুয়েক ধরে চলা সাশ্রয়ী নীতির সুতোয় কিছুটা ঢিল দিলেন অর্থমন্ত্রী, সীমিত পরিসরে কৃচ্ছ্রসাধনের কথাও বললেন। দুই অংক ছুঁইছুঁই মূল্যস্ফীতির আঁচ থেকে দরিদ্রদের বাঁচাতে সরকার কী কী করেছে, বাজেট বক্তৃতায় দিলেন সেই বিবরণ।
কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গিয়ে যেসব পদক্ষেপের কথা অর্থমন্ত্রী বললেন, তা মূল্যস্ফীতির জন্য সহনীয় হবে না বলেই অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা।
জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশের সমান বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ঋণের যে ছক তিনি কষেছেন, তা বেসরকারি বিনিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা থাকল। বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য দেওয়া এ বাজেটে কিছু না পাওয়ার হতাশা বাজল বিশ্লেষকদের কণ্ঠে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বললেন, এক বছরে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা যদি সরকার ব্যাংক থেকে নেয়, তাহলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়া নিয়ে জটিলতা হতে পারে।
বরং সরকার যদি বিদেশ থেকে ওই অর্থ ঋণ নেয়, সেটা ‘ভালো’ হতে পারে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের এই নেতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংকিং সেক্টরের যে অবস্থা, দুরবাস্থা বলব… মানুষ তো ব্যাংকে টাকাই রাখছে না, আস্থা নেই। ব্যাংক থেকে কি করে টাকা নেবে সরকার?
“অলরেডি বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত। আমার মনে হয়, ব্যয়টা সাশ্রয় করলে ঘাটতি কিছু কমবে। ব্যয়টা করতে হবে যাতে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ে।”
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে পরিস্থিতি, তাতে বাজেটের আকার ‘ঠিকই আছে’।
তবে বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্য সরকার ধরছে, সেটাকে ঠিক বলতে পারছেন না তিনি।
প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া এসেছে গবেষণা সংস্থা সিপিডির কাছ থেকেও।
মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কতটা ’বাস্তবসম্মত’
বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংসদে ঢোকেন অর্থমন্ত্রী। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশের ৫৪তম বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তিনি। তার আগে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল বিজয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম এ বাজেট অর্থমন্ত্রী হিসেবে মাহমুদ আলীর জন্যও প্রথম। এই দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে চাপে থাকা অর্থনীতির উদ্বেগ জাগানো সূচকগুলো মাথায় রেখে সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নের অঙ্ক মেলাতে হয়েছে তাকে।
বাজেট বক্তৃতায় স্বাধীনতালগ্ন থেকে বারবার বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস তুলে ধরে ৮১ বছর বয়সী মাহমুদ আলী রাজস্ব, আর্থিক, ডিজিটালসহ একগুচ্ছ সংস্কারের কথা তুলে ধরেন। সেখানে উন্নয়নকে টেকসই করার প্রতিশ্রুতিও আসে।
১৭৪ পৃষ্ঠার বাজেট উপস্থাপন করে নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ধরার কথা বলেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের আগের নানান উদ্যোগ কাজে না আসার পরও এখনকার ১০ শতাংশের কাছাকাছি মূলস্ফীতির মধ্যেও এ লক্ষ্যকে ‘বাস্তবসম্মত’ মনে করছেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন।
তিনি বলেন, “এটা সঠিক উদ্যোগ। মূল্যস্ফীতি কমাতে এটা সহায়তা করবে। সাথে সাথে বাজারটা মনিটর করতে হবে।”
ঋণের চাপও ভোগাবে মূল্যস্ফীতিকে
নানামুখী অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে অর্থনীতির ছাত্র ও স্বল্প সময়ের শিক্ষক অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তার ১৭ শতাংশের বেশি তাকে জোগাড় করতে হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।
আর প্রস্তাবিত বাজেটের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হলে ৩৬ শতাংশের বেশিই জোগাড় করতে হবে ঋণ করে।
সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার মত ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন মাহমুদ আলী। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে ব্যাংক থেকে।
তার প্রস্তাবিত ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা) চেয়ে ১১.৫৬ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৪.২৪ শতাংশের সমান।
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গত সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৫.২১ শতাংশের সমান।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে পরিস্থিতি, তাতে বাজেটের আকার ‘ঠিকই আছে’।
তবে বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্য সরকার ধরছে, সেটাকে ঠিক বলতে পারছেন না তিনি।
অর্থমন্ত্রী দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায় অনেক কথা বলেছেন। উন্নয়ন আর সরকারের সার্বিক কার্যক্রমের ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন মাঝেমধ্যেই। তবে সুনির্দিষ্ট করে সাধারণের জীবন কঠিন করে তোলা মূল্যস্ফীতি কমানো, কর্মসংস্থান বাড়াতে বিনিয়োগ আকর্ষণে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা হাজির করেননি।
খরচ বাড়াবে করারোপ
উল্টো অনেক ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক বাড়িয়ে সাধারণের পাশাপাশি ব্যবসার খরচের বোঝা বাড়িয়েছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের বিনির্মাণের পথে থাকার এ সময়ে মোবাইল ফোনের কথা বলার উপর শুল্ক বাড়িয়েছেন। কিছু চিকিৎসা সেবার ব্যয় বাড়ছে নতুন করা বসানোর কারণে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, টেলিকম খাতে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি।
“কিছু কিছু জায়গায় আয়কর বাড়নো হয়েছে। যেটা সবসময়ই থাকে। কিন্তু আমি মনে করি, টেলিকম সেক্টরের ওপর করহার বাড়ানো যৌক্তিক না। এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি প্রোডাক্টিভ খাত। এ খাতটি রাজস্বও দিচ্ছে, প্রবৃদ্ধিও দিচ্ছে। তাহলে এই টেলিকম খাতে কর বাড়ানো হল কেন?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা মধ্যবিত্তদের করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ”অতিধনীদের আরও বেশি করের আওতায় আনা যেত। বরং মধ্যবিত্তদের করমুক্ত আয়সীমা পরিবর্তন করা যেত।
“আমি একটু অবাক হলাম, এবারের বাজেট বক্তৃতায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য খুব বেশি প্রণোদনা লক্ষ্য করিনি। এই জায়গাটায় সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি, গ্রামীণ অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু ওই জায়গাগুলাতে আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। যে জায়গায় কর ছাড় দিলে আমরা আরো বেশি রিটার্ন আনতে পারি, সেই জায়গাটায় কর ছাড় দেওয়াটা যৌক্তিক।”
সামাজিক নিরাপত্তার পদক্ষেপ কেমন হল
অতি দরিদ্রদের সহায়তায় সরকারের এগিয়ে আসার পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। শুধু প্রতিবন্ধীদের ভাতা ৯৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০৫০ টাকা করা হয়েছে। সঙ্গে উপকারভোগীর সংখ্যা সাত লাখের মতো বাড়ানো হয়েছে।
তবে অতি দরিদ্রদের জন্য নেওয়া বাজেটের এ পদক্ষেপ খুশী করতে পারেনি বিশ্লেষকদের। তারা অনেকদিন থেকে এর আওতা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলে আসছিলেন।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টিনীর আওতায় টাকার অঙ্কে বরাদ্দ অনেক বেশি হলেও তাতে শুভঙ্করের ফাঁকি দেখছেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
তাৎক্ষণিক বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো উচিত নয়। এটি মোট বাজেট বরাদ্দের ৯.২ শতাংশ দেখানো হয়। এতে পেনশন, সেভিংস সার্টিফিকেট, কৃষি ভর্তুকিসহ আরও কিছু যুক্ত করে জিডিপির ২ শতাংশের বেশি করা হয়। তবে এগুলো বাদ দিলে তা নেমে আসে ১ শতাংশে।
আইএমএফের ছাপ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলে আসা অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলীকে তার প্রথম বাজেট সাজানোর আগে থেকে আইএমএফকে নিয়ে ভাবতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির ভর্তকি কমানোসহ নানা শর্ত পরিপালনের চাপ অর্থনীতির এ কঠিন সময়ে আরও অস্বস্তি তৈরি করেছে।
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটেও ছিল শর্ত পূরণের ছাপ। সেবার সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। আর এবার তা বাস্তবায়নের কাজে হাত দেওয়ার পদক্ষেপের কথা জানাতে হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতসহ বাজেটের অনেকগুলো অংশে তার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়।
অর্থমন্ত্রী কোথাও এসব বিষয়ে আইএমএফের কথা উচ্চারণ করেননি। তবে সংস্থাটি যে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে সেটি তুলে ধরেছেন তার বক্তৃতায়। ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিমুক্ত থাকায় বাংলাদেশের সক্ষমতায় সংস্থাটির প্রশংসার কথা তুলে ধরেছেন।
আইএমএফের পরামর্শ মেনে রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরেছেন।
রাজস্বে সংস্কারে জোর
রাজস্ব খাতের দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের অংশ হিসেবে করজাল সম্প্রসারণ, অটোমেশনে জোর দেওয়াসহ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের বিস্তারিত বর্ণনা দেন তিনি। রাজস্ব বাড়িয়ে নিজেদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কথা বলেন।
তিনি বলেন, চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং অভ্যন্তরীণ সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে রাজস্ব খাতের যুগোপযোগী সংস্কার করা হচ্ছে।
রাজস্ব আহরণে এনবিআর বিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রায় ৬৮ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন।
তার প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১৩.১৮ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন মাহমুদ আলী। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৭ শতাংশের বেশি। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৬০ শতাংশের মত।
গতবারের মত এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইএমএফের চাপ রয়েছে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের কাছাকাছি নেওয়ার। নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হলেও তা রাজস্ব আহরণের হারের থেকে কম। অর্থবছর শেষে এটি অর্জন করাও দূরহ ঠেকছে তাদের কাছে।
রাজস্ব আদায় সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হলেও বাজেটে করের আওতা বাড়ানোর জন্য খুব বেশি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে মনে করছেন অধ্যাপক সায়মা হক।
তিনি বলেন, “বাজেটের আকার ৫ শতাংশের মত বাড়ানো হয়েছে। সার্বিকভাবে আমরা যদি রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে না পারি, তাহলে আমরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব না।”
সরকারের আয় বাড়াতে গিয়ে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। জমি ও ফ্ল্যাটে আগের বিনিয়োগও বৈধ করা যাবে এলাকাভেদে কর দিয়ে।
এ নিয়ে অন্য অর্থনীতিবিদদের মত আপত্তি আছে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদেরও।
তিনি বলেন, “যেখানে আয়ের উপর সর্বোচ্চ কর আছে ৩০%, এটা অত্যন্ত যুক্তিহীন কাজ। আমার সর্বোচ্চ আয়ের উপর ৩০% ট্যাক্স দেব, আর কালো টাকা নিয়ে ১৫% ট্যাক্স দেব। এটা কী করে হয়?”
প্রবৃদ্ধির উচ্চাশায় যতি
কোভিডের পর অর্থনীতির সংকট চলতে থাকলেও মুস্তফা কামাল বাজেটের আকার বাড়িয়ে পরিকল্পনা সাজানোর পুরনো ধারায় যতি দেননি গত অর্থবছর পর্যন্ত। কিন্তু এবার মাহমুদ আলী কিছুটা সংযত।
মূল্যস্ফীতি, টাকার দরপতনসহ বেশ কিছু সমস্যায় কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সূচক যখন চাপের মুখে, তখন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছেন বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে কমিয়ে।
বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন মুস্তফা কামাল। ৬ মাসের প্রাক্কলনের ভিত্তিতে অর্থবছর শেষে তা ৫.৮ শতাংশ হবে বলে সরকার ধারণা করছে। আর মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৮৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, তার নতুন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশের মধ্যে আটকে রেখেই ৬.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) প্রথম সাত মাসের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে অর্থনীতির আকার বাড়তে পারে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হরে।
গত কয়েক বছর আওয়ামী লীগ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ধরলেও এবার কিছুটা পিছিয়ে আসার স্পষ্ট ব্যাখ্যা বাজেট বক্তৃতায় দেননি কূটনৈতিক জীবন থেকে অবসরে গিয়ে রাজনীতিতে নামা অর্থনীতির ছাত্র মাহমুদ আলী।
ভর্তুকির হালচাল
আইএমএফের শর্তের কারণে চাইলে ভর্তুকি খুব বেশি বাড়ানোর পথে যেতে পারেননি তিনি।
বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ মোট ৮৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী, যেখানে বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ৮৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। তার মানে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ আগের চেয়ে ১৭২০ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সাধারণের ওপর চাপ কমাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে যেমন স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা দেখা যায়নি, তেমনি মোবাইল ফোনে কথা বলা, মোবাইল সিম, আইসক্রিম, চিকিৎসা ব্যয়ের পাশাপাশি পর্যটনে কর বাড়িয়ে সাধারণের খরচ বাড়ানোর পথ তৈরি করেছেন।
মধ্যম পর্যায়ের আমানতকারী ও ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
অপরদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আওতা (সংখ্যা) বাড়িয়ে সেগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশের যাত্রাপথের প্রস্তুতি
পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্ততায় রাজস্ব আহরণ ও ব্যবসা বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নের আলোচনায় এলডিসি গ্রাজুয়েশন ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় যাওয়ার আকাঙ্খার কথা তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত দেড় দশকে দেশ বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের অর্জন অতুলনীয়। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের উত্তরণ ঘটবে। তবে এ উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সকল নিয়ম-কানুন অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মত সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
“আমাদের দেশে প্রস্তুতকৃত পণ্য বর্তমানে বিভিন্ন দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রেফারেনসিয়াল শুল্কে ও কোটামুক্ত প্রবেশের সুবিধা পেয়ে থাকে যা উত্তরণের পর ক্রমান্বয়ে হ্রাস হবে। রপ্তানিতে যে নগদ প্রণোদনা প্রদান করা হয় তাও পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং একইসাথে আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক-কর হার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে হবে।”
এতে দেশে প্রস্তুত করা যেসব পণ্য উচ্চ আমদানি শুল্কের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরক্ষণ সুবিধা পেয়ে আসছে আগামীতে তারা মুক্ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলছেন, পরিবর্তিত এ বাস্তবতায় স্থানীয় শিল্পকে নিজেদের দক্ষতা ও কৌশল দিয়েই বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে।
’ব্যাংক মার্জারের সুফল পেতে সময় লাগবে’
লম্বা বাজেট বক্তৃতায় মাহমুদ আলী দরিদ্রতা কমাতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপসহ দেশের আর্থসামাজিক খাতে অগ্রগতি ও উন্নয়ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, মৃত্যু হার হ্রাস, দারিদ্র হ্রাস, সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রত্যাশা অনুযায়ী বরাদ্দ না আসার সমালোচনাও এসেছে।
অনিয়মের অসুখে ভুগতে থাকা ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরাতে তেমন জোরালো পদক্ষেপের কথা না বললেও আর্থিক খাতে সংস্কারের কথা বলেছেন। এ নিয়েও আইএমএফের চাপ রয়েছে।
আলোচিত ব্যাংক মার্জার নিয়ে বাজেট বক্তৃতায় কিছু না বললেও সামষ্টিক অর্থনীতিরি নীতি বিবৃতিতে বলেছেন, খেলাপি ঋণ ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে কিছু ব্যাংক একত্রীকরণের মত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রার পথে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরলেও অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় বর্তমান সংকট কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা কীভাবে ঘুরবে তা নেই। স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা কেমন হবে সেই দিশা নেই। টেকসই উন্নয়নের দিকে কীভাবে এগোবে তা নেই।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলছে, চ্যালেঞ্জিং সময়ে এই বাজেটে ‘উদ্ভাবনমূলক ও সাহসী পদক্ষেপ নেই’।
[প্রতিবেদন তৈরি করেছেন ফয়সাল আতিক, মাসুম বিল্লাহ, কাজী নাফিয়া রহমান, শেখ আবু তালেব, ওবায়দুর মাসুম, গোলাম মতুর্জা অন্তু, মাছুম কামাল, আবুল বাশার সাজ্জাদ]