এনবিআরের হিসাবে সাড়ে তিন বছরে বকেয়া প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ মাসেই বকেয়া পাঁচ হাজার কোটির কাছাকাছি।
Published : 13 Dec 2024, 12:00 PM
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস-এলএনজি আমদানির বিপরীতে ভ্যাট কত, এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলার মধ্যে মতভেদের মধ্যে শুল্ক বকেয়া বেড়েই চলেছে।
চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসেই বকেয়া পড়েছে ৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যার ২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকাই নভেম্বরে।
এ নিয়ে ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের-এনবিআর কাছে পেট্রোবাংলার বকেয়া দাঁড়াল ১৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা।
‘বকেয়া আদায় করতে না পারায় রাজস্ব আহরণের সংস্থা দেশের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না’ উল্লেখ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ কমিশনার মো. জাকির হোসেন এনবিআরকে বুধবার চিঠি দিয়ে বকেয়া আদায়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগেও মো. জাকির হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বকেয়ার কথা স্বীকার করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এনবিআর ‘অন্যায়ভাবে’ শুল্ক ও ভ্যাট বসানোয় বকেয়া বাড়ছে। এ সংস্থার নীতির কারণে পেট্রোবাংলাকে এলএনজিতে দুইবার ১৭ শতাংশ করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক ও ভ্যাট দিতে হচ্ছে।”
চালের পর এলএনজিকে ‘সবচেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য’ দাবি করে এনবিআরের এ নীতির সমালোচনা করে বলেন, “একবার আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। এর পর আবার এলএনজি গ্যাস আকারে যখন সরবরাহ হয় তখন আবার ১৭ শতাংশ দিতে হয়। টোটাল ৩৫ শতাংশ দিতে হয়।”
এ নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা হলেও ‘সুরাহা না হওয়ায় বাধ্য হয়ে’ এ টাকা পেট্রোবাংলাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যখন আমরা অর্থায়ন পাব তখন এটা পরিশোধ করে দিব।”
এলএনজি আমদানি বাড়ছে
শীত আসার আগেই গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতির শঙ্কায় সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানির থেকে দুই কার্গো এলএনজি কেনার পাশাপাশি দ্বীপরাষ্ট্র ব্রুনাইয়ের কাছ থেকে সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি কেনার একটি প্রস্তাব পাস হয় নভেম্বরে।
অক্টোবরের প্রথম দিকেই সিঙ্গাপুর থেকে দুই কার্গো এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
শিল্পে ও বাসাবাড়িতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি আগেই হওয়া চুক্তির আলোকে আমদানি বাড়ায় পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলার তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম তিনমাসেই এলএনজি আমদানি করা হয় ১ দশমিক ১৫৭ মিলিয়ন টন। এর পরের তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের আমদানি তথ্যে দেখা যায়, এলএনজি আমদানির বিপরীতে পেট্রোবাংলা বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেছে ৩৪টি; যা এককমাস বিবেচনায় সর্বোচ্চ।
প্রতি বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে কী পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হয়েছে তার তথ্য না মিললেও এর বিপরীতে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা; এটিও একক মাস বিবেচনায় সর্বোচ্চ রাজস্বের পরিমাণ। এর আগে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার রাজস্বের তথ্য মিলে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে।
হঠাৎ আমদানি বাড়ার কারণ জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বলেন, “অন্য বছরের তুলনায় এবারের গ্যাস সংকট বেশি।”
বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা অন্তত ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে অন্য বছরের শীতে ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের জোগান দেশীয় উৎস থেকে মিললেও এবার তা অনেক কম জানিয়ে তিনি বলেন, “সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত যেন না হয় তাই এলএনজি আমদানি বাড়তি করতে হচ্ছে।”
কত বিল অব এন্ট্রি, বকেয়া কবে থেকে
আমদানি করা এলএনজি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ায় গ্যাস পরিবহনকারী কার্গো জাহাজ থেকে মহেশখালীতে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালে আনলোড করা হয়। এই ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরাসরি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য মতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে অপরিশোধিত বিল অব এন্ট্রির সংখ্যা ২৩৫টি। সাকুল্যে শুল্ক-কর বা রাজস্বের বকেয়া দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা।
বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করা বিষয়ে চিঠিতে কাস্টম হাউজ লিখেছে, কাস্টমস আইন অনুযায়ী, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রেরিত বিল অব এন্ট্রিসহ আনুষঙ্গিক দলিলাদি সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটে দাখিল করতে হয়। তাতে পণ্য শুল্কায়ন ও শুল্ক-কর পরিশোধ করে খালাসের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু পণ্যচালান আমদানি হওয়ার এক মাস পরেও বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়নি। যা কাস্টমস আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তরফে এখন পর্যন্ত বকেয়া আদায়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বরাবর ৩৭টি চিঠি পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, প্রতি মাসে চট্টগ্রাম কাস্টম থেকে একাধিক চিঠি ও টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলেও চলতি বছরের আগস্টের পর কোন বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি।
বকেয়া পরিশোধ না করার জেরে ২০২২ সালে পেট্রোবাংলাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তবে এর কোন উত্তর দেয়নি পেট্রোবাংলা। এরপর বকেয়া পরিশোধ না করা হলে কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিন লক, পণ্য খালাস বন্ধ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হবে বলে জানানো হয়।
এই চিঠির উত্তরে পেট্রোবাংলা জানায়, অর্থ বিভাগ থেকে ভর্তুকি পেয়ে এলএনজি আমদানি পর্যায়ে বকেয়া শুল্ক-কর পরিশোধ করা হবে।
সর্বশেষ সংস্থাটি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সরবরাহ কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে এলএনজি আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধের দায় থেকে অব্যাহতি চেয়ে এনবিআরের কাছে চিঠি দিয়েছে।
ঋণ নিয়ে এনবিআরের পাওনা মেটাচ্ছে
আমদানি শুল্কের পাশাপাশি ভ্যাট বাবদ ২২ হাজার কোটি টাকারও বেশি বকেয়া আছে পেট্রোবাংলার। এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বকেয়া আদায়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অর্থ সংকটে দীর্ঘদিনের জমে থাকা এনবিআর বিপুল পাওনা পরিশোধ করতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঋণ নিচ্ছে পেট্রোবাংলা; এরই মধ্যে তা থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে ভ্যাটের ৫ হাজার কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা এনবিআরকে পরিশোধ করতে পেট্রোবাংলাকে ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে অর্থ বিভাগের।
আরও পড়ুন
ঋণ নিয়ে এনবিআরের ৩৭৫০০ কোটি টাকা পাওনা মেটাচ্ছে পেট্রোবাংলা
দুই কার্গো এলএনজি কিনছে সরকার, ব্রুনাইয়ের সঙ্গে হবে দীর্ঘমেয়াদি চ