এরই মধ্যে ভ্যাটের ৫,০০০ কোটি টাকা দিয়েছে জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।
Published : 25 Jun 2024, 10:04 PM
অর্থ সংকটে দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিপুল পাওনা পরিশোধ করতে না পেরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঋণ নিচ্ছে পেট্রোবাংলা; এরই মধ্যে তা থেকে পরিশোধ করা হয়েছে ভ্যাটের ৫ হাজার কোটি টাকা।
শুল্ক, ভ্যাট (মূসক) ও আয়কর মিলিয়ে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে এনবিআরের মোট পাওনা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি আমদানির বিপুল ব্যয় মেটাতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়ায় বকেয়ার এ পরিমাণ দীর্ঘদিন থেকে বেড়েছে।
এমন অবস্থায় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিয়ে এনবিআরের বকেয়া পরিশোধ করার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। এর অংশ হিসেবে ভ্যাটের বকেয়া ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করার তথ্য দেন তিনি।
সোম ও মঙ্গলবার ব্যাংক চালানের মাধ্যমে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটকে এ টাকা পরিশোধ করা হয়।
তবে এ খাতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কত টাকা ঋণ মিলছে এবং কত বছরের জন্য তা দেওয়া হচ্ছে, সেসবের বিস্তারিত বলেননি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান।
নগদে পরিশোধের বাইরে হিসাব সমন্বয়ের মাধ্যমেও এনবিআরের বকেয়া পরিশোধ করবে পেট্রোবাংলা। সংস্থাগুলোর এক যৌথসভায় গত মে মাসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, শুধু ভ্যাটেই বকেয়া ছিল ২২ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।
ভ্যাটের বাইরে আয়কর ও আমদানি শুল্ক বাবদ পাওনা রয়েছে আরও ১৪ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে এলএনজি আমদানির শুল্ক হিসেবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ পেট্রোবাংলার কাছে পাবে ১৪ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা।
অর্থ সংকটে শুধু এনবিআরের বকেয়া নয়, আমদানি করা জ্বালানির বিশেষ করে এলএনজি আমদানির দায়ও মেটাতে পারছে না পেট্রোবাংলা। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ঋণ চাওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ নিতে সংস্থাটির উদ্যোগের বিষয়টি খবর এসেছে।
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ বলেন, জ্বালানি আমদানির দায় মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ বছর মেয়াদী ঋণ নেওয়া হচ্ছে।
জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থার অর্থ সংকটে পড়ার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ম তামিম এর মূল কারণ হিসেবে দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতের সমস্যা ও ডলার সংকটের কথা তুলে ধরেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পেট্রোবাংলা দেশের জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে এলএনজি আমদানি করতে যেয়ে অর্থ সংকটে পড়ছে। এটি অর্থের অভাবের প্রতিফলন।
”দেশে কোনো কিছুর ঘাটতি হলে তখন সেটির প্রভাব অন্য জায়গায়ও পড়ে। যেমন ডলারের সংকটের জন্য জ্বালানি খাতের এখন বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থায় পেমেন্ট বকেয়ার পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ফলে জ্বালানি খাতের আয় কমে গেছে, সংস্থাগুলো শুল্ক ও মূসক পরিশোধও করতে পারছে না।”
এনবিআরের বকেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের সংস্থাগুলোর নিজেদের মধ্যে বকেয়া পরিশোধে ধীরতা সবসময়ই দেখা যায়।
”সরকারি সংস্থা হিসেবে তারা এই সুযোগ নেয়। এক্ষেত্রে তাদের যেসকল পেমেন্ট আগে পরিশোধ করতে হবে, না করলে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে, সেসব তারা অগ্রাধিকার দেয়। পেট্রোবাংলার এই বকেয়া গত ৩-৪ বছরের না। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।”
এতে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারী তামিম।
এসব ঘাটতি কমাতে দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতের সংকট মোকাবেলায় জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সামগ্রিক আর্থিক খাতের সংকট কমলে অর্থের অভাব, রাজস্ব বা ডলারের সংকট কেটে যাবে।
এদিকে বিপুল এ পাওনা পরিশোধের বিষয়ে গত ২০ মে এনবিআরের সঙ্গে এক বৈঠকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, বিদ্যুৎ ও সার খাতে গ্যাস বিক্রির পাওনা অর্থ পেলে এনবিআরের সব পাওনা তারা পরিশোধ করে দিতে পারবেন।
এমন প্রেক্ষাপটে শুল্ক, কর ও ভ্যাটের বকেয়া এ অর্থ নগদের পাশাপাশি সরকারের দুই সংস্থার মধ্যে বুক অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে সমন্বয় করার কথা ওই বৈঠকে তুলে ধরে পেট্রোবাংলা।
গত ২০ মে এনবিআরে অনুষ্ঠিত অর্থ বিভাগ, জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও বিপিসির যৌথসভার কার্যবিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বকেয়া পাওনার ১৩,২৭৮ কোটি টাকা (সুদ ছাড়া) পর্যায়ক্রমে বুক এডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বকেয়া বাকি রাজস্বও আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বুক এডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে পরিশোধে অর্থ বিভাগ ব্যবস্থা নেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
বিপিসির কাছে এনবিআরের পাওনা ১৭,২২৬ কোটি টাকা
পেট্রোবাংলা ছাড়াও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এবং এর বিপননকারী কোম্পানির কাছে এনবিআরের মোট বকেয়া আরও ১৭,২২৬ কোটি টাকা।
এরমধ্যে বিপিসির কাছে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বাবদ বকেয়া ৬,৮৯৯ কোটি, তিতাস গ্যাসের কাছে ২,২৮৪ কোটি, পদ্মা অয়েলের কাছে ২,১৪৫ কোটি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের কাছে ১,৭৩৫ কোটি ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কাছে বকেয়া ১,০২৮ কোটি টাকা।