বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি হাই কমিশনার।
Published : 29 May 2024, 11:23 PM
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে উঠেছে, তা ‘সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির হাই কমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম।
বুধবার ঢাকায় ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের (ডিকাব) সঙ্গে মতবিনিময়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ মন্তব্য করেন।
হাই কমিশনার বলেন, “কিছু বিষয় রয়েছে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যেটা আপনি সিন্ডিকেটের বিষয়ে বলেছেন। এটা এমন একটা বিষয়, তা মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশ কোনো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে এর সমাধানের জন্য দুই দেশের সরকার পরস্পরকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।”
মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ২০১৬ সালে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
পাঁচ বছর মেয়াদী এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিকে।
কিন্তু অভিযোগ ওঠে, প্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে এজেন্সিগুলোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট’ করে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে দুই বছরে শ্রমিকদের ২০০ কোটি রিঙ্গিত হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে বাংলাদেশি কর্মীদের আর ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া। তবে আগে যারা ভিসা পেয়েছিলেন, তারা পরেও মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পান।
সরকারের তরফে নানা দেন-দরবার আর করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে শ্রমিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়া।
প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের অগাস্টে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আবারও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ; কিন্তু আবারও সিন্ডিকেট কর্মীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠছে।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়ে গত ২৮ মার্চ দুদেশের সরকারকে একটি চিঠি পাঠানোর কথা জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়।
দুই সরকারের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া না আসায় কমিশনের চার জন বিশেষজ্ঞের দেওয়া ওই চিঠি ২৬ মে তারিখে প্রকাশ করে জাতিসংঘের এই সংস্থা।
চিঠিতে বলা হয়, শ্রমিকদের নিয়োগের বিষয়টি শুরুই হয় ‘ঘুষ’ লেনদেনের মাধ্যমে। আর মালয়েশিয়ার মন্ত্রণালয়গুলো, বাংলাদেশ মিশন এবং সিন্ডিকেটের ‘দুর্নীতির’ কারণে বাংলাদেশি কর্মীদের সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে ‘আট গুণ বেশি’ ব্যয় করতে হচ্ছে।
এর আগে ১৯ এপ্রিল এক বিবৃতিতে ওই বিশেষজ্ঞরা বলেন, “আমরা খবর পেয়েছি দুদেশের উচ্চ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা এই কাজে জড়িত বা সহযোগিতা করছে। এটা অগ্রহণযোগ্য এবং থামানো প্রয়োজন। এমন শোষণমূলক নিয়োগের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”
বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গত বছর ঢাকায় মালয়েশিয়ান হাই কমিশনে কাজ করে যাওয়া দুই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছিল দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন।
ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ টেনে হাই কমিশনার বলেন, “আমার সরকার কতটা আন্তরিক এই গ্রেপ্তার তার উদাহরণ এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করে যাচ্ছি আমরা; পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
জাতিসংঘের চার র্যাপোর্টিয়ায়ের চিঠির বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এসব অভিযোগের বিষয়ে উত্তর দেওয়ার অবস্থানে আমি নেই। তবে আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি, পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য মালয়েশিয়ার সরকার বেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আন্তরিক।”
এয়ারলাইন্সের মুনাফা প্রত্যাবাসনে দরকার সরকারের ‘বিবেচনা’
সব বিদেশি এয়ারলাইন্সের মত মালয়েশিয়ার বিমান পরিবহন কোম্পানিগুলোর টিকেট বিক্রির মুনাফার টাকাও বাংলাদেশে আটকে আছে। তারা যাতে ওই অর্থ মালয়েশিয়ায় ফিরিয়ে নিতে পারে, সেজন্য সরকারের সুবিবেচনা প্রত্যাশা করছেন হাই কমিশনার হাজনাহ।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার টিকেটের ‘অতিরিক্ত দামের’ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি মুনাফা ঘরে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধার বিষয়টিকেও কারণ হিসেবে তুলে ধরেন।
হাই কমিশনার বলেন, কোভিড-১৯ মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিমান যোগাযোগে বেশ কম হয়। এ কারণে ভাড়ার ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্সগুলোর ‘কোনো বিকল্প ছিল না। ব্যবসা চালু রাখার স্বার্থেই তারা ভাড়া বাড়িয়েছে’।
বাংলাদেশ থেকে মুনাফার অর্থ দেশে নিতে বেগ পাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “মহামারীর পরে এয়ারলাইন্সগুলো এখানে ফান্ড বা মুনাফা সরিয়ে নিতে ‘চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা’ করছে।
“আমরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে সদয় বিবেচনা চেয়েছি। বাংলাদেশ সরকার আমাদের বন্ধু, আমরা বিশ্বাস করি তারা বিষয়টি সদয় বিবেচনা করবেন।”
হাই কমিশনার বলেন, “আমি মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন্সের কথা বলছি। তবে, ফান্ড ও মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে অন্যরাও একই রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এটা এখন বেশ চ্যালেঞ্জিং।
“ভাড়াকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে এটাও অন্যতম ফ্যাক্টর। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা পেলে আমরা এটা আরও ভালো করতে পারব।”
দিনশেষে বাজারের ‘চাহিদা-জোগানের’ নিয়মে উড়োজাহাজের টিকেটের দাম নির্ধারিত হয় বলেও মন্তব্য করেন হাজনাহ মো. হাশিম।
নিয়োগ পাওয়া বিদেশি কর্মীদের ৩১ মে তারিখের মধ্যে কর্মস্থলে ফেরার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার; এর মধ্যে অতিরিক্ত চাহিদার কারণে বিমান ভাড়া বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর যেতে উড়োজাহাজের টিকিটের সর্বোচ্চ দাম থাকে সাধারণত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। চলতি মাসের শুরু থেকেই তা তিন গুণের বেশি হয়ে যায়। মাসের মাঝামাঝি সময়ে এটি ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা হয়।
মালয়েশিয়ার টিকেটের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে এক প্রশ্নে বুধবার বিমান বাংলাদেশের বিদায়ী এমডি শফিউল আজম বলেন, “৩০ মের মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অনেক শ্রমিক পাঠাতে হবে মালয়েশিয়ায়। আমরা ধারণা করে নিয়মিত ফ্লাইটের পাশপাশি আরও চারটি ফ্লাইট দিয়েছি। আমাদের টিকিট কিন্তু সব ওপেন করে দেওয়া আছে। আমরাই সর্বনিম্ন ৭০ হাজার টাকা টিকিট বিক্রি করছি।
“আর ওই এজেন্সির লোকেরা কিনে নিয়ে মানুষের কাছ থেকে নিচ্ছে বিভিন্ন দাম। প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো এক লাখ ২০ হাজারেও বিক্রি করছে।”
তিনি বলেন, “এখন এজেন্সিগুলো যদি বাইরে টিকিট নিয়ে এভাবে বিক্রি করে, তাহলে বিমানের কী করার আছে আমাকে বলেন? আমরা চেষ্টা করছি মালয়েশিয়ায় আরও স্লট পেতে। আমরা স্লট পাওয়া মাত্র টিকিট ওপেন করে দিয়েছি।
“আপনারা যে কোনো এক্সপার্ট নিয়ে আসেন। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে এখানে সিন্ডিকেট আছে, তো আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি আমার লোকজনের শাস্তি আমি এনশিওর করব।”
এয়ার টিকেটের দাম বাড়া এবং টিকেট পেতে বাংলাদেশি কর্মীদের ভোগান্তির বিবেচনায় নিয়ে কর্মীদের ফেরার সময় বাড়ানো হবে কি-না, এমন প্রশ্নে হাই কমিশনার হাজনাহ বলেন, “এখন পর্যন্ত আমাদের জানামতে, আমরা ওই তারিখেই স্থির থাকছি।”
‘বাংলাদেশের জন্য আসিয়ান বাজারের হাব হতে পারে মালয়েশিয়া’
বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার উপর জোর দেন মালয়েশিয়ার হাই কমিশনার হাজনাহ।
ব্যবসা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়াকে ‘হাব’ হিসাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ আসিয়ানের বাজারে ঢুকতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
হাই কমিশনার বলেন, এফটিএ’র মাধ্যমে বাংলাদেশি পণ্যকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে মালয়েশিয়ায়, একইভাবে মালয়েশিয়ার পণ্যও বাংলাদেশে সমান সুবিধা পাবে।
“সুতরাং এটা দুই পক্ষকেই লাভবান করবে। কিন্তু শুধু মালয়েশিয়ায় নয়, আপনাদের পণ্য যখন মালয়েশিয়ায় ঢুকবে, তখন এটা পুরো আসিয়ানের বাজারও পাবে। এটা আসিয়ানের হাবের মত। সুতরাং, সেই বাজারে যাওয়ার জন্য আপনারা মালয়েশিয়ার বাজারকে হাব হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন।”
এফটিএর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে হাই কমিশনার হাজনাহ বলেন, এফটিএ করাকে বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা দূর করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসাবে দেখছে মালয়েশিয়া। দুদেশের মধ্যে ২৬০ কোটি ডলারের যে বাণিজ্য, তাতে বাংলাদেশের হিস্যা ৩০ কোটির মত।
“এ কারণে আমাদের এফটিএ দরকার। এফটিএ আপনাদের জন্য বাজারে প্রবেশগম্যতা আনবে। আপনাদের কৃষি ও গার্মেন্টস পণ্যের ঢোকার সুযোগ হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে আপনারা এখনকার সুবিধাও হারাবেন। তখন আরও প্রতিযোগিতাসক্ষম হওয়ার জন্য আপনাদের এফটিএ দরকার হবে।”