ফুটপাতের দোকানে এবার নতুন নোটের দাম আগের চেয়ে দ্বিগুণ বলে জানাচ্ছেন ক্রেতারা।
Published : 12 Apr 2023, 10:23 PM
রোজার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্তি বাড়ছিল নাজমুল আহমেদের; মতিঝিলে বাংলাদেশ ভবনের নিচ তলায় এই লাইনে তিনি ছিলেন নতুন নোটের জন্য।
বুধবার বিকাল পৌনে ৩টায়ও তিনি যখন লাইনে, তখনও তার সামনে জনা পঞ্চাশেক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। সাড়ে ১১টায় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন বলে জানান নাজমুল।
“কয়টায় নতুন টাকা পাব, জানি না। পুরো দিন পার হয়ে গেল টাকা নিতে এসে,” বিরক্তি ভরে বলেন তিনি।
নাজমুলের এই লাইনে টোকেন দেওয়া হয়, তার জন্য আঙ্গুলের ছাপ নিতে হয়। আর তাতে দেরি হওয়ায় লাইন হয়ে যায় দীর্ঘ।
তবে টোকেন নেওয়ার পর যে কাউন্টার থেকে নতুন নোট নিতে হয়, সেখানে কোনো ভিড় নেই। টোকেনধারীরা গেলেই মিলছে টাকা। তবে সেই পর্যন্ত পৌঁছতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে সবার।
ব্যাংকের ভেতরে যখন বিড়ম্বনার এই চিত্র; বাইরে ফুটপাতে চিত্র একেবারে ভিন্ন। সেখানে থরে থরে নতুন নোট সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। সেখান থেকে বেশি টাকা দিয়ে কেনা যাচ্ছে নতুন নোট।
ব্যাংকের ভেতরে ভিড় দেখে অনেকে সেখান থেকে নতুন নোট কিনে নিচ্ছিলেন, তাদেরই একজন তৌফিকুল আলম বললেন, “ভেতরে (বাংলাদেশ ব্যাংক) বেশি ভিড়, লাইনে দাঁড়ালে অনেক সময় যাবে। তাই বেশি দাম দিয়ে নিলাম।”
প্রতিবারের মতো এবারও ঈদে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছেড়েছে সাধারণ মানুষের জন্য।
ঢাকার মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের নিচ তলায় আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা আড়াইটা পর্যন্ত একজন সাড়ে ৮ হাজার টাকার বিভিন্ন মানের নতুন নোট বিনিময় করতে পারছেন।
এই রোজার ঈদে ১৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়ার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক বছর ৫ টাকার কাগুজে নোট বাজারে না ছাড়লেও এবার তাও পাওয়া যাচ্ছে।
আঙুলের ছাপে বিড়ম্বনা
একজন ব্যক্তি এক বারের বেশি নতুন নোট নিতে পারবেন না, এমন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য নোট নিতে আসা প্রত্যেক ব্যক্তির আঙুলের ছাপ ইলেকট্রনিক ডিভাইসে নিয়ে রাখা হচ্ছে, যা দ্বিতীয় বার কেউ এলে তাকে শনাক্ত করা যায়।
সেই মেশিনে প্রথমে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ দিলে একটি টোকেন বেরিয়ে আসে যেখানে সিরিয়াল নম্বর লেখা থাকে। ডান হাতের আঙ্গুলের ছাপ না উঠলে চেষ্টা করা হয় বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের।
সরেজমিনে দেখা যায়, এই ছাপ নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগার কথা থাকলেও একেকজনের ক্ষেত্রে ৩০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিটও লেগে যাচ্ছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ১৭ সেকেন্ডে ছাপ নেওয়া হতে দেখা গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় লাগছে। দুই মিনিটের বেশি সময় লাগার ঘটনাও ঘটছে।
ফলে লাইন দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আঙুলের ছাপ সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া তদারকি করতে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের ৫ জন কর্মীকেও গলদঘর্ম হতে দেখা যায়।
একটি মাত্র মেশিনে আঙুলের ছাপ নেওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে মেঝের উপর বসেও পড়ছিলেন কেউ কেউ।
ধানমণ্ডি থেকে আসা নাজমুলের মতো কয়েকশ মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কয়েক ঘণ্টা ধরে।
আজিমপুর থেকে আসা মেহেদী হাসান রাসেল বলেন, “সাড়ে ৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। এতো লম্বা লাইন শেষই হয় না।”
বেলা ১১টা থেকে লাইনে জানিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে আসা নুর উদ্দিন বলেন, “লাইন কখনও এগোয়, তারপর আবার বসে থাকতে হয়। একটা মাত্র মেশিনে ছাপ নিচ্ছে, আর কাউন্টার করেছে ৫টা। মেশিন বাড়ালেই হয়।”
টাকার কাউন্টার ফাঁকা
টোকেন পাওয়া ব্যক্তিদের নতুন নোট বিনিময় করতে ৫টি কাউন্টার খুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু টোকেন নিতে যখন লম্বা লাইন, সেখানে পাঁচটি কাউন্টারই ফাঁকা।
কোনো ব্যক্তি টোকেন পাওয়ার পর কাউন্টারে গিয়েই টাকা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারছিলেন। ফলে কাউন্টারে থাকা কর্মকর্তাদের কোনো ঝক্কিই পোহাতে হচ্ছিল না।
নতুন নোট নিতে আসা ব্যক্তিদের বিড়ম্বনার বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারিগরি ও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে এটি হয়েছে। আঙুলের ছাপ নিতে সময় লেগেছে বেশি।”
এজন্য ইন্টারনেটের গতিকে দায়ী করে তিনি বলেন, “যে গতিতে ইন্টারনেট পাওয়ার কথা, তা না থাকায় মেশিন স্লো কাজ করেছে। আমাদের টিম কাজ করছে-সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছাড়া শাখা অফিসেও নতুন নোট বিনিময় হচ্ছে। ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের ৪০টি শাখার মাধ্যমে নতুন নোট সংগ্রহ করা যাচ্ছে।
বিদ্যমান নোট জমা দিয়ে ৫, ১০, ২০ ও ৫০ টাকা মূল্যমান পর্যন্ত নতুন নোট নেওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ হাজার টাকার। কেউ চাইলে যে কোনো পরিমাণের ধাতব মুদ্রাও নিতে পারছেন।
ফুটপাতে বেশি দামে নতুন টাকা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনের ফুটপাতে নতুন টাকার নোট বিক্রি করতে দেখা গেছে বেশ কয়েকজনকে। তারা নতুন নোটের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন।
ব্যাংকের ভেতরে ভিড় দেখে তৌফিকুলে মতো অনেকে সেখান থেকে নোট কিনছিলেন দরদাম করে।
সেনা কল্যাণ সংস্থার সামনের ফুটপাতের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ টাকার দুটি আর ২০ টাকার একটি বান্ডিল (প্রতিটিতে ১০০টি নোট) তৌফিকুল নিলেন অতিরিক্ত ৬০০ টাকা দিয়ে।
দরদাম করে ৫৫০ টাকা বেশি দিতে চাইলেও বিক্রেতা রাজি হননি। অগত্যা তিনটি বান্ডিলের প্রতিটিতে ২০০ টাকা করে বেশি দিত হয় তাকে।
ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতবার ১০ টাকার একটি বান্ডিল অতিরিক্ত দিতে হয়েছিল সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এবার সেখানে দ্বিগুণ দাম দিতে হচ্ছে।
সারা বছরই নতুন নোট বাড়তি দরে বিক্রি হতে দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে। ঈদের সময়ে মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও ডালা সাজিয়ে বসেন। কিন্তু এবার তাদের সংখ্যা কম দেখা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ছাড়াও রাজধানীর গুলিস্তান, সদরঘাট, মিরপুর, ফার্মগেইট, রায়সাহেব বাজার এলাকায় নতুন নোটের পসরা বসিয়ে থাকেন নিয়মিত ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।