“সরকার এই নীতিতে অটল থাকলে ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে সুফল মিলবে,” বলেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।
Published : 09 Jul 2024, 01:40 AM
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে সরকারের পক্ষ থেকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, সুদের হার বাড়ানোসহ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার কোনো কিছুরই তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না পণ্য বাজারে।
মূল্যস্ফীতি কমার নাম নেই, বরং একেক সময় একেক ধরনের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, দুই বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির হার রয়েছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
অর্থাৎ, দুই বছর আগের ১০০ টাকার খরচ এখন ১২০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে, যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচককে (মূল্যস্ফীতি) ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন সরকার। পরে তা সংশোধন করে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়, তবে সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি, বরং তা ছিল আগের বছরের চেয়ে বেশি।
বিবিএসের তথ্য বলছে, সদ্য সমাপ্ত মাস জুনে খাদ্যপণ্যের দাম সামান্য কমায় ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়ে গেছে।
অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার আদতে বাজারভিত্তিক সংকোচন নীতি নিয়েছে মে মাসে, এর আগে ভুল নীতিতে ছিল। আর জুনে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।
“এটি শক্তভাবে ধরে রাখা গেলে আমি মনে করি ৬ থেকে ৯ মাসের মাঝে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।”
সরকার সংকোচন নীতির কথা বললেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে টাকা ছাপানোর কথা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে কাজ করে আসা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “গত অর্থবছরে সেই ধারা না দেখলেও টাকা ছাপানোর আগের প্রভাব এখনও রয়ে গেছে।
“আমরা এখনও জুনের হালনাগাদ তথ্য পাইনি। তবে আমার মনে হয় সরকার জুনেও টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি পূরণ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সহায়তা। এর ফলে আদতে অর্থের যে চাপ, সেটি আর থাকছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ার এটাও একটি কারণ।”
আবার বাংলাদেশের পণ্যবাজারে পশ্চিমা দেশের অর্থনীতির মত শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়। এখানে হুটহাট নানা পণ্যের দাম বেড়ে যায়, বাজারে কোনো না কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একজোট হয়ে কারসাজির বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি সংস্থার আলোচনাতেও। অতিমুনাফার প্রবণতাও এখানে স্পষ্ট। সরকার পাইকারি ও খুচরা বাজারে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য ঘোষণা করলেও তা কার্যকর হয়নি।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর একচেটিয়া ব্যবসার বিপরীতে সরকার নানা সময় ঘোষণা দিয়েও বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে পারেনি।
পদক্ষেপ ‘যথেষ্ট ছিল না’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, কেবল নীতি সুদহার বাড়ানো, সুদের হার বাজারভিত্তিক করার মাধ্যমে সংকোচন নীতিই বাংলাদেশের জন্য ‘যথেষ্ট না’।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীল খাত, বিশেষত ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
“বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে এবং শক্তভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করতে হবে যাতে ‘অসাধু’ সিন্ডিকেট, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা পণ্য স্টক করা ও মূল্য বাড়াতে না পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদহার বাড়িয়ে সুদের হার বাজারভিত্তিক করে আমরা অর্থের চাহিদা কমিয়েছি। রাজস্ব নীতির মাধ্যমে অর্থের যোগানও একইরকম হওয়ার কথা। তবে এক্ষেত্রে সংকোচন না করা গেলে সহসাই মূল্যস্ফীতি কমে না।”
যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মে মাসে চার বছর পর সুদহারের সীমা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; ফলে তখন থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ঋণ ও আমানতের সুদহার নিজেরা ঠিক করতে পারে।
২০২২ সালের জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশে ও ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছিল। পরে ঋণের সুদহার নির্ধারণে ‘স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলস- স্মার্ট) পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
এরপর আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময়হারও চাহিদা ও যোগানভিত্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিনিময় হার নির্ধারণ করে আসছিল ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেই তারা কাজটি করত।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এবিবি ও বাফেদার উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে বিনিময় হার পুরোপুরো বাজারমুখী করার কথাও বলেছিলেন গভর্নর।
সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন না হলেও ক্রলিং পেগ নামে এক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, যার পর এক দিনেই ডলারের বিপরীতে টাকা দর হারায় প্রায় ৭ শতাংশ।
এই নীতি গ্রহণ করে ডলারের বিনিময়হার ১১৭ টাকা নির্ধারণ হওয়ার পর টাকা অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে। গত ৮ মার্চ এই নীতি গ্রহণের পর দুই মাসে টাকা ও ডলারের দরে কোনো হেরফের হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের টাকা ধার করার প্রবণতাও কমেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড ৯৭ হাজার ৬৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ঋণ করে।
অর্থনীতির ভাষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ঋণকে বলা হয় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অর্থ প্রচলন। বলা হয়, এই অর্থ আসলে টাকা ছাপানো। এর বিপরীতে সমপরিমাণ পণ্য বা সেবা উৎপাদিত না হলে এটি মূল্যস্ফীতি বাড়ায়।
গত অর্থবছরে সরকার এক্ষেত্রেও উন্নতি করেছে। অর্থবছরের মে পর্যন্ত সরকার ১৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
তবে আগের অর্থবছরে ছাপানো সব টাকা বাজার থেকে না তুলতে পারার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে রয়ে গেছে।
সংকোচন নীতির মধ্যেই ইসলামি ব্যাংকগুলোকে বাড়তি সুবিধা
একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কথা বলছে, অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকসহ তফসিলভুক্ত ব্যাংকগুলোকে দেওয়া তারল্য সহায়তা বাজারে অর্থের যোগান বাড়াচ্ছে।
এই নীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধরে রাখতে ভূমিকা রাখছে কি না, সে আলোচনাও আছে।
এই প্রশ্নে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, “মুদ্রানীতির ফলে অর্থের বাজারে আগের তুলনায় অতিরিক্ত তারল্য কমে গেছে। কিছু ব্যাংকে চাপ বেশি, কিছু ব্যাংকে কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করেছে।”
তবে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, “ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দেওয়া খারাপ; সরকারের এ বিষয়ে সতর্কতা জরুরি।”
তারল্য সহায়তা না দিয়ে ব্যাংকগুলোর সংস্কার এবং মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে সরকারের রাজস্ব নীতি তৈরিতে গুরুত্ব দিয়েছেন আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা।
বাজারে ‘কারসাজি’র কী হবে?
টানা এক দশক স্থিতিশীল থাকার পর দুই বছর ধরে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, সেখানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একাধিকবার করপোরেট কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিযোগিতা কমিশনও বাজারে কারসাজির দায়ে নামি দুটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপও এই পণ্যের বাজার স্থিতিশীল করতে পারেনি।
দুই বছর ধরে আলুর দাম তৈরি করেছে বিস্ময়, অথচ উৎপাদনে সে রকম কোনো সংকটের তথ্য আসেনি কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে। পেঁয়াজের দরও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।
বছর জুড়েই নানা সময় নানা ধরনের পণ্যের দাম ও সরবরাহ নিয়ে কারসাজির অভিযোগ উঠে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি হিসেবে গোলাম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি কোনো ব্যবসায়ী অনৈতিকভাবে অতি মুনাফা করে, সরকারের নানা কর্তৃপক্ষ আছে, তাদের কাজ হল এই ব্যবসায়ীদের ধরা। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্য বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। সরকারের এ বিষয়ে সঠিক নজর দিতে হবে।”
মূল্যস্ফীতি বাড়ার মূল কারণ হিসেবে তিনিও সরকারের ‘ভুল নীতির’ কথা বলেন।
“বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যখন যেভাবে করা দরকার, সেভাবে করা হয় না। সারা পৃথিবী যেখানে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা করেনি। ক্রমান্বয়ে বিনিময় হার বাড়ায়নি। টাকা ছাপিয়েছে, ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
“কথায় আছে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাইই হয়েছে। সরকার যদি এখন সব সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, আর যদি ভুল সিদ্ধান্ত না নেয়, তাও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে সময় লাগবে। এক্ষেত্রে ৬ থেকে ৯ মাস, এমনকি বছরও লেগে যেতে পারে।”
অর্থমন্ত্রীর লক্ষ্য ‘উচ্চাভিলাষী’
গত দুই বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগলেও নতুন অর্থবছরে অনেকটা উন্নতি করতে চান অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এক্ষেত্রে তিনি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঠিক করেছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যের কথা বলেছেন তিনি।
তবে এই লক্ষ্য অর্জনে বাজেট বক্তব্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা ঘোষণা করা হয়নি, বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনেও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য পূরণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনার কথা তিনি জানাতে পারেননি।