চিকিৎসার জন্য দলবেঁধে শহরে এসে পুড়ে বৃদ্ধার মৃত্যু, দগ্ধ ৬ স্বজন

চিকিৎসার জন্য ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের ছয়জন মিলে ফেনীর দাগনভূঁইয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে এসেছিলেন ৬০ বছরের পিয়ারা বেগম। এখানে বড় ছেলের এক কক্ষের বাসায় উঠার পর আগুন লেগে পুড়ে মারা গেছেন তিনি। আর দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তার ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে ছয় স্বজন।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2020, 02:45 PM
Updated : 9 Nov 2020, 03:44 PM

রোববার রাতে নগরীর আকবর শাহ থানার উত্তর কাট্টলীর বিশ্বাসপাড়া এলাকায় ‘মরিয়ম ভিলা’ নামের একটি ছয়তলা ভবনের ষষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাটে অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনা ঘটে।

আগুনে পিয়ারা বেগমের সঙ্গে তার বড় ছেলে মিজানুর রহমান (৪২), ছোট ছেলে সাইফুর রহমান (১৮), মেয়ে সুমাইয়া ২৫, মিজানুরের স্ত্রী বিবি সুলতানা মুন্নী এবং তাদের আট ও দুই বছরের নাতি মাহের ও মানহাও দগ্ধ হন।

চট্টগ্রামের ওয়াইএসি লজিস্টিক নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিজানুর দুই কক্ষের ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে এক কক্ষে থাকতেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানরা ছিল গ্রামের বাড়িতে।  

মিজানুর কয়েক মাস আগে ফ্ল্যাটের অপর কক্ষটি সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিয়েছিলেন রিয়াজুল ইসলাম ও সালমা জাহান নামে এক দম্পতিকে। আগুনে তারাও দগ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘরে আগুনে দগ্ধ হওয়ার পর সবাইকে নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকাল ১১টার দিকে মারা যান পিয়ারা বেগম। তার শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

এরপর তার অপর ছয় স্বজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।

সকালে দগ্ধদের ঢাকায় নেওয়ার পথে পিয়ারা বেগমের বড় মেয়ের স্বামী মো. মুন্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কিছু দিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন পিয়ারা বেগম। তার চিকিৎসার জন্য শুক্রবার চট্টগ্রামে আসেন। এ সময় ছোট ছেলে সাইফুর, মেয়ে সুমাইয়া, বড় ছেলের স্ত্রী বিবি সুলতানা মুন্নী এবং তার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সবাই একসাথে আসেন।

আকবর শাহ থানার ওসি জহির হোসেন জানান, তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন দগ্ধ সাইফুর রহমান দাগনভূঁইয়ার মুটবি সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার এইচএসসির ছাত্র এবং তার বোন সুমাইয়া নোয়াখালীর একটি কলেজের প্যারামেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। আর মিজানুরের স্ত্রী দাগনভূইয়া উপজেলার উত্তর কৌশল্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার আলী জামান আল-সোলায়মান জানান, মিজানুরের শরীরের ৪৮ শতাংশ, তার ছোট ভাই সাইফুরের ২২ শতাংশ, বোন সুমাইয়ার ১৫ শতাংশ, স্ত্রী বিবি সুলতানা মুন্নীর ২০ শতাংশ এবং তাদের দুই সন্তান মাহেরের ৫ শতাংশ ও মানহার ২০ শতাংশ করে পুড়ে গেছে।

এছাড়া ওই বাসার সাবলেট রিয়াজুলের ১৮ শতাংশ এবং তার স্ত্রী সালমা জাহানের দেহের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে।

“এদের মধ্যে মাহের, মানহা ও সালমা জাহান ছাড়া সবার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। সাইফুরের শরীর তুলনামূলক কম দগ্ধ হলেও তার অবস্থা বেশি আশঙ্কাজনক,” বলেন চিকিৎসক সোলায়মান।

রিয়াজুল ও সালমা দম্পতি ছাড়া অন্যদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা চুলার গ্যাস থেকে আগুন ধরেছে বলে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেলেও বিদ্যুৎ ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কর্তৃপক্ষ কেউই তার দায় নিচ্ছে না।

অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ওই বাসায় গিয়েছিলেন জানিয়ে আকবর শাহ থানার ওসি জহির হোসেন বলেন, “তাদের ধারণা, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। বাসার প্রতিটি কক্ষের বৈদ্যুতিক তার গলে গেছে। বিষয়টি আমরাও তদন্ত করে দেখছি।”

তবে দগ্ধদের পোড়ার যে ধরন, তাতে ওসির বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক আলী জামান আল-সোলায়মান।

তিনি বলেন, “বৈদ্যুতিক আগুনে দগ্ধদের ক্ষত বেশি হয়। আহতদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে গ্যাসের আগুনে তারা দগ্ধ হয়েছেন। তাদের অধিকাংশের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে।"

সকালে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের পাশাপাশি কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) এবং বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

পরির্দশন শেষে পিডিবির বিতরণ বিভাগ পাহাড়তলীর সহকারী প্রকৌশলী তৌফিকুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাসার বিদ্যুৎ মিটার, লাইনসহ সব কিছু ঠিক আছে। প্রাথমিকভাবে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, ওই অগ্নিকাণ্ড বৈদ্যুতিক কারণে ঘটেনি।

“বাসার বিদ্যুৎ লাইনের ওয়্যারিং ঠিক আছে। প্রতিটি রুমে ফিউজ লাগানো ছিল, কিন্তু সেগুলো পোড়েনি। বিদ্যুতের সমস্যা হলে সেগুলো পুড়ে যেত। লাইট ফেটে গেলেও সেগুলোর সার্কিট ভালো আছে। বাসার যে তারগুলো পুড়ে গেছে প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হচ্ছে অতিরিক্ত হিটের কারণে সেগুলো পুড়েছে।”

অন্যদিকে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের জিএম (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) প্রকৌশলী সরোয়ার হোসেন বলেন, “সকালে আমাদের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ওই বাসার গ্যাস রাইজার, গ্যাস লাইন এবং চুলার কিছুই হয়নি। সেখান থেকে আমরা বলতে পারি, গ্যাসের লাইনের কোনো ত্রুটি ছিল না।

ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসাইন জানিয়েছেন।