চবিতে ‘বিধি লঙ্ঘন করে’ গবেষণা সুপারভাইজারের দায়িত্বে শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষক

নিয়ম লঙ্ঘন করে শাস্তি পাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করায় ফের বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2020, 09:49 AM
Updated : 23 Oct 2020, 09:49 AM

যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেই ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।

তবে তিনি বলছেন, সব নিয়ম মেনে যথাযযথ সব কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়ার পরই শিক্ষার্থীরা তার অধীনে গবেষণা করছেন। এখানে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে থাকলে তার দায় কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়।

২০০৮ সালের ২৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ‘নিয়মবহির্ভূত কাজ করা, বিভাগের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট করা এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধি লঙ্ঘনের’ অভিযোগে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনকে পরীক্ষা সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রম থেকে ৫ বছরের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হয়।

পরে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১৫ মার্চের সিন্ডিকেট সভায় পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ থেকে বিরত রাখার শাস্তির অবশিষ্ট সময়কাল (২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত) রহিত করে তাকে পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়।

কিন্তু অধ্যাপক ফরিদকে এমফিল ও পিএইচডির সুপারভাইজার হওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা সেখানে বলা হয়নি।

এরপরও তার সুপারভাইজার থাকার বিষয়টিকে ‘বেআইনি’ বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অনেকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালের এম ফিল ও পিএইডি কোর্সের গবেষণা নীতিমালার ১১ (চ) ধারায় বলা হয়েছে, অ্যাকাডেমিক ও পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতি করার দায়ে যে শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি থেকে অপসারণ/বরখাস্ত করা হয় বা বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয় অথবা চাকরিরত অবস্থায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তিনি এমফিল ও পিএইচডি কোর্সের ছাত্র-ছাত্রীদের সুপারভাইজার, যুগ্ম সুপারভাইজার, পরীক্ষা কমিটির কনভেনর বা পরীক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে কাজে নিয়োজিত থাকলে তাকে বাদ দিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়ান্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কোনো শিক্ষক পরীক্ষা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি আর কখনো এমফিল ও পিএইচডি কোর্সের সুপারভাইজার হতে পারেন না ।

"কিন্তু সেই বিধি লঙ্ঘন করেই অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহামেদকে গবেষকের সুপারভাইজারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা নিয়মবহির্ভূত ও অন্যায়।"

অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ যে এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছেন, তা স্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. দেলোয়ার হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি পরীক্ষা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং সে অনুয়াযী শাস্তি পান, তাহলে ওই শিক্ষক এমফিল ও পিএইচডি কোর্সের সুপারভাইজার হতে পারেন না।”

তাহলে ফরিদ উদ্দিন আহামেদ কীভাবে তা করছেন জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা শাখার তথ্য অনুযায়ী, অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহামেদ ২০১৬ সালে ফের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর পর থেকে তার অধীনে একজন গবেষক এমফিল ও তিনজন পিএইচডি করছেন।

অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিধি লঙ্ঘন করে কেউ সুপারভাইজার হতে পারে না; তেমনি পরীক্ষার্থীদেরও বিধি লঙ্ঘন করে এমফিল, পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে এমফিল, পিএইডি কোর্সের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকভাবে যাবতীয় কর্মপন্থা অবলম্বন করে রেজিস্ট্রার দপ্তরে তাদের আবেদনপত্র জমা দেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা যাচাই বাছাই করে অ্যাকাডেমিক কমিটিতে পাঠায়। অনুষদের ফ্যাকাল্টি মিটিংয়ের মন্তব্যসহ তা আবার রেজিস্ট্রার দপ্তরে পাঠানো হয়। এরপর বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের চূড়ান্ত অনুমোদনের পরই একজন শিক্ষার্থী এসব কোর্সে ভর্তি হতে পারে।

“একজন শিক্ষার্থী যদি এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এমফিল বা পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হয় এবং তারপরও যদি বিধিলঙ্ঘন হয় বা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে এর দায় তো সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং অন্যান্য বিধিবদ্ধ পর্যদের ওপর বর্তায়, কোনভাবেই শিক্ষার্থী বা সুপারভাইজারের ওপর নয়।"

নিয়মে সুযোগ না থালেও ফ্যাকাল্টি মিটিংয়ে কীভাবে ফরিদ উদ্দিন আহামেদকে সুপারভাইজারের দ্বায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করা হল জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফ্যাকাল্টি মিটিংয়ে আগে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা আমি জানি না, তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহামেদকে একজন গবেষেকের কো-সুপারভাইজারের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব হয়েছিল। আমরা দেখেছি এটি নিয়ম অনুযায়ী এখানে আসেনি। তাই অনুমোদন না দিয়ে বিষয়টি যথাযথ নিয়মে আসার জন্য পুনরায় বিভাগের পাঠিয়ে দিই।"

আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা যে অন্যায় হয়েছে, সেটা আমিও মানি। ওই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সাবেক ভিসির সময়। অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন তখন সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ছিলেন। আমার ধারণা, সংশ্লিষ্ট পর্ষদগুলো বিষয়টি হয়ত খেয়াল করেনি। পুজার ছুটির পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ফ্যাকাল্টি মিটিংয়ে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহামেদকে যখন সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেওয়া হয়, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

তিনি ইতোমধ্যে চাকরি শেষ করে অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে যাওয়ায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।