সিসিসি: ‘অস্বচ্ছ’ প্রক্রিয়ায় দুই হাজার কর্মী নিয়োগ

‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্পে আর্বজনা অপসারণ কাজে দুই হাজার ‘সেবক’ নিয়োগে কোনো ধাপই অনুসরণ করা হয়নি, নেই কারও নিয়োগপত্র। প্রতি মাসে বেতন পেলেও শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই সিটি করপোরেশনেও।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2020, 04:10 PM
Updated : 29 Sept 2020, 05:00 PM

এই পুরো প্রক্রিয়া ‘অবিশ্বাস্য হলেও তা বাস্তবতা’ বলে মূল্যায়ন এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির।

যার মেয়াদে এসব নিয়োগ হয়েছে সেই সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের দাবি, ‘অস্থায়ী’ শ্রমিক নিয়োগে যে নিয়ম অনুসরণ করা প্রয়োজন, তা করা হয়েছে।

আর বর্তমান প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন জানতে চান, আসলে শ্রমিক হিসেবে কারা নিয়োগ পেয়েছেন, আর বাস্তবে কারা কাজ করছেন।

এ বিষয়টি তদন্ত করতে ১৮ অগাস্ট করা তিন সদস্যের কমিটি ২২ সেপ্টেম্বর প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

নিয়োগ প্রক্রিয়া ‘অনুসরণ হয়নি’

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ৩১ অগাস্ট দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (সিসিসি) দুই হাজার অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন দেয়।

শুরুতে আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয় সিসিসি। পরে তা স্থগিত করে আবার নতুন বিজ্ঞাপন দেয়।

কমিটির প্রধান সিসিসি’র প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মুফিদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আবেদনপত্র গ্রহণ ও যাচাই বাছাই, নিয়োগ কমিটি গঠন, পরীক্ষা বা সাক্ষাৎকার, নিয়োগ আদেশ ও নিয়োগপত্র দেওয়া এবং সবশেষে প্রত্যেকের জন্য পৃথক ফাইল খোলা এভাবে আগাতে হয়। এর কোনোটাই করা হয়নি।”  

নিয়োগের এক মাসের মধ্যে শ্রমিকদের তথ্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এবং ছবিসহ তথ্য সংরক্ষণের কথা থাকলেও সেসব করা হয়নি।

পরিচ্ছন্ন বিভাগ থেকে কত আবেদনপত্র বিতরণ করা হয়েছে, কতজন নিয়োগ পায় এবং যাদের আবেদন বাতিল হয় তা কেন হয়, এ বিষয়েও তথ্য না থাকায় তা যাচাই করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

সেসময় সাদা কাগজে করা অবেদনের উপর মেয়র আ জ ম নাছির ‘ব্যবস্থা নিন’ লিখে সাক্ষর করে, পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বরাবরে প্রেরণ করেন। এরপর নিয়োগ পাওয়াদের ব্যাংক হিসেব খোলা হয়।

পরিচ্ছন্ন বিভাগ তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছে, শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া ‘মেয়রের নির্দেশ মোতাবেক’ হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির বলেন, তারা চতুর্থ শ্রেণির অস্থায়ী কর্মচারী। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ ভিত্তিতে নিয়োগ।

“এক্ষেত্রে যেসব ধাপের কথা বলা হচ্ছে, তা অনুসরণের আবশ্যকতা নেই। শুরুতে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের উদ্যোগ নিলেও মন্ত্রণালয় বলে- যেহেতু অর্গানোগ্রাম নেই এভাবে করা যাবে না। ডোর টু ডোর নতুন ধারণা, আপনারা চিঠি দেন, আমরা অনুমোদন দেব। সেভাবেই অনুমোদন দেওয়া হয় দুই হাজার শ্রমিকের।”

তাহলে নিয়োগ কীভাবে হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে নাছির বলেন, সাধারণ সভায় আলোচনার পর প্রতি ওয়ার্ডে কাজ করতে আগ্রহীদের কাউন্সিলরা পাঠাবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। তারপর যাচাই করে নিয়োগ হয়। 

তবে প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে নিয়োগের অনেক ধাপই অনুসরণ করা হয়নি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- “শ্রমিকদের দক্ষতা যাচাই হয়নি, অনেক শিক্ষিত শ্রমিক নিয়োগ পেয়েছে। পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। অনেক অযোগ্য, অদক্ষ, কাউন্সিলর এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মীয়-স্বজন শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।”

শ্রমিক আছে, তথ্য নেই

মন্ত্রণালয় দুই হাজার শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন দিলেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২০৬৫ জন। এমনকি সবশেষ অগাস্ট মাসেও ৫৩ জন শ্রমিক নিয়োগ পেয়েছে।

সাবেক মেয়র নাছির অগাস্টে ৫৩ জন নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “যে প্রক্রিয়ার কথা বলছেন, তা অনুসরণ করেই কি এদের নিয়োগ হয়েছে?

ডোর টু ডোর প্রকল্পের এই নিয়োগের আগে সিসিসিতে ৭৩০ জন স্থায়ী এবং ৮৯৮ জন অস্থায়ী পরিচ্ছন্ন কর্মী ছিল। বর্তমানে মোট পরিচ্ছন্নকর্মীর সংখ্যা ৩৬৯৩ জন।

পরিচ্ছন্ন বিভাগ ও সচিবালয় শাখা কেউই নিয়োগ পাওয়া শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তদন্ত কমিটিকে দিতে পারেনি।

কোনো ডাটাবেইজ না থাকায় নিয়োগ পাওয়াদের দেওয়া তথ্যের সত্যতাও যাচাই করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। দুই হাজার লোক নিয়োগে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে কিন্তু বিস্তারিত তথ্য নেই।

“নামসহ আবার প্রতিবেদন দিতে বলেছি। তখন বুঝতে পারব কে নিয়োগ পেয়েছে, কোন ওয়ার্ডে পেয়েছে, আর কে কাজ করছে। তদন্ত শুরু হওয়ায় চাপে পড়ে অনেকেই এখন কাজে নেমেছে। আগে কাজ না করেই হাজিরা দিয়ে বেতন নিয়েছে। একজনের নামে অন্যজনও কাজ করেছে।”

পরিচ্ছন্ন ও সচিবালয় বিভাগ থেকে বেতনের আগে শ্রমিক সংখ্যার অনুমোদন নেওয়া হলেও তাতে একেক মাসে শ্রমিকের সংখ্যা একেক রকম দেখা গেছে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়োগ পাওয়া শ্রমিক ছিলেন ১৬৯৪ জন। সেই মাসে বেতন দেয়া হয় এক কোটি ৫৫ লাখ ১৮২৬ টাকা।

এরপর থেকে প্রায় প্রতি মাসে শ্রমিকের সংখ্যা ও বেতনের অংক বেড়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয় ১৭৯০ জন। বেতন দেয়া হয় এক কোটি ৬৮ লাখ ৬৫ হাজার ৮২০টাকা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ১৯৮০ জন শ্রমিকের বিপরীতে দুই কোটি আট লাখ ৭৩ হাজার ১০৩ টাকা বেতন দেয়া হয়।

সবশেষ জুলাই মাসে ২০১২ জন শ্রমিকের বিপরীতে বেতন দেয়া হয় দুই কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৭ টাকা।

শ্রমিকদের দৈনিক ৩২৪ টাকা মজুরিতে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের অগাস্টে সেই বেতন ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দৈনিক ৩৫৭ টাকা করা হয়। যার কোনো অনুমোদন নেই।

তদন্তে উঠে আসে- সচিবালয় শাখাকে ‘পাশ কাটিয়ে’ নিয়োগ হলেও মাস শেষে দুই কোটি ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৭ টাকা বেতন হিসেবে দেয়া হচ্ছে।

তদন্ত কমিটি এ পরিস্থিতিকে ‘অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তবতা’ বলে উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনে। পাশাপাশি হিসাব বিভাগ প্রয়োজনীয় নথিপত্র ছাড়া এত বিপুল পরিমাণ টাকা ছাড় করানোর দায় ‘এড়াতে পারে না’ বলে মন্তব্য করে।

প্রতিবেদনে কমিটি মন্তব্য করে- আইনকানুন পরিপালনে পরিচ্ছন্ন বিভাগ ও হিসাব বিভাগ ‘অতিমাত্রায় উদাসীন’।

এমনকি ‘ভৌতিক হাজিরা’র অস্তিত্ব আছে বলেও তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

সব তথ্য চূড়ান্তভাবে পাওয়া গেলে তারপরই নিয়োগপত্র দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানান প্রশাসক সুজন।