হালদার আপদ চোরা শিকারীরা, বিপদে মা মাছ-ডলফিন

প্রজনন মৌসুমে হালদায় মা মাছের আনাগোনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে চোরা শিকারীদের উৎপাত; আর তাতে বিপদে পড়েছে মাছ ও ডলফিন।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2020, 03:39 AM
Updated : 11 May 2020, 03:39 AM

টানা অভিযানও দমাতে পারছে না চোরা শিকারীদের। এমনকি মরিয়া শিকারীরা নদীতে রাসায়নিক দিয়েও মা মাছ ধরছে বলে খবর মিলেছে।

নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দা, ডিম আহরণকারী, জনপ্রতিনিধি ও জেলেরা সচেতন না হলে হালদায় মা মাছ শিকার ঠেকানো যাবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত প্রজনন মৌসুমে কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় মা মাছের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে।

চলতি বছর মধ্য এপ্রিল থেকে হালদায় মা মাছের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান ডিম সংগ্রহকারী আশু বড়ুয়া ও কামাল সওদাগর।

হাটহাজারী উপজেলার মাদার্শা এলাকার ডিম আহরণকারী আশু বড়ুয়া বলেন, “নদীতে মা মাছ বাড়ার সাথে সাথে চোরা শিকারীও বেড়ে গেছে। তারা রাতে জাল বসিয়ে মাছ ধরছে।”

 ১৮ এপ্রিল রাত পৌনে ১১টায় হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের কান্তজার বাজার এলাকায় বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেই নদীতে মাছ শিকারে নামে ৩০ জনের চোরা শিকারির একটি দল।

হালদায় ‘বিষ’ (রাসায়নিক) দিয়ে মাছ শিকার করছে এমন খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন। চোরা শিকারিরা জাল ফেলে পালিয়ে যায়। সেদিন ৫০০ মিটার জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়।

নদীতে শিকারীদের পাতা জাল থেকে মা মাছ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। আর জালে আটকে পড়া ডলফিন শিকারীদের নির্মমতার শিকার হয়েছে শুক্রবার।

বেসরকারি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) স্বেচ্ছাসেবক রওশনগীর আলম বলেন, “৩০ এপ্রিল রাতে কাগতিয়া খালের মুখে বসানো জালে আটকা ১২ কেজির মা কাতাল মাছ উদ্ধার করি। প্রায় চারশ ফুট জাল জব্দ করি। পরে মাছটি নদীতে ছেড়ে দিই।”

এর আগে ২১ এপ্রিল দিনের বেলায় নদীর নয়ারহাট থেকে হালদার মুখ (কালুরঘাট) পর্যন্ত অংশে জেলা মৎস্য বিভাগের নেতৃত্বে অভিযানে চালিয়ে ৭০টি জাল, ২৯ এপ্রিল হাটহাজারীর ছিপাতলি ইউনিয়নের আলমের কুম এলাকা থেকে দেড় হাজার মিটার এবং ৬ মে নয়ারহাট থেকে হালদার মুখ অংশে হাটাহাজারী ও রাউজান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের যৌথ অভিযানে ১০ হাজার মিটার জাল জব্দ করা হয়।

জালে আটকা মাছ-ডলফিন

হালদায় মূলত ঘের জাল ও ভাসা জাল নামের দুই রকমের জাল পেতে শিকার করা হয় মা মাছ।

ঘের জাল বাজারে তেমন বিক্রি হয় না। চোরা শিকারিরা সুতা দিয়ে হাতে বুনে তৈরি করে এই জাল।

নদীর তীর ঘেষে বড় এলাকা জুড়ে বাঁশের খুঁটি পোতা হয় ভাটার সময়। আশেপাশে ডাল-লতাপাতা টেনে খাবার ছিটিয়ে জোয়ারের সময় বাঁশের খুঁটিতে আটকে পাতা হয় ঘের জাল। খাবারের সন্ধানে ঘেরে ঢুকে আটকা পড়ে নদীর বাঁক ঘেষে চলা মা মাছ।

আর নদীর মাঝ বরাবর আড়াআড়ি পাতা হয় ভাসা জাল। এতে মা মাছের পাশাপাশি আটকা পড়ে ডলফিনও।

গত দেড় বছর ধরে হালদায় টানা অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া হাটহাজারীর ইউএনও মো. রুহুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হালদায় পাতা ৯০ শতাংশই ঘের জাল। এগুলো রাতের বেলা বেশি বসানো হয়। মাছ ধরায় অভিজ্ঞ লোকজন ছাড়া এই জাল পাতা সম্ভব না।”

নদীর ‘ব্রিডিং গ্রাউন্ড’ খ্যাত সাত্তার খালের মুখ থেকে রামদাশ মুন্সির হাট পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং উজানের সমিতির হাট আলমের কুম পর্যন্ত আরো প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশে মা মাছের চলাচল বেশি থাকে প্রজনন মৌসুমে।

হালদা যেখানে কর্ণফুলীর সাথে মিশেছে সেই কালুরঘাট সেতুর কাছের অংশ থেকে উজানে মদুনাঘাট হয়ে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে নদীর দুই তীরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি এই তিন উপজেলা।

কালুরঘাট থেকে সমিতির হাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশ ঘিরেই প্রজনন মৌসুমে চলে চোরা শিকারীদের উৎপাত।

হাটহাজারী উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রজনন মৌসুমে চোরা শিকারীদের ঠেকাতে আমরা নিয়মিত দিনে-রাতে অভিযান চালাচ্ছি।”

নদীর পাড়েই চোরা শিকারী

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা রাত বিরাতে হালদায় মা মাছ ধরতে জাল বসায় তারা দূরবর্তী কোনো এলাকার বাসিন্দা নয়।

“নদীর খুব কাছে থাকা লোকজনই এ কাজ করে। তাই হালদা পাড়ের বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করে মাছ শিকার ঠেকাতে পিকেএসএফ-আইডিএফ ৪০ জন স্থানীয় বাসিন্দাকে নিয়েই স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছে।”

আইডিএফ’র স্বেচ্ছাসেবক রওশনগীর আলম বলেন, “যখনই খবর পাই আমরা স্পিডবোট নিয়ে নদীতে মাছ শিকারীদের থামাতে নেমে পড়ি। এছাড়া নিয়মিত টহল তো আছেই। তবু চোরা শিকারীদের ঠেকানো যাচ্ছে না।”

রাউজান উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা পীযূষ প্রভাকর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিকারীদের সাথে চোর-পুলিশ খেলা চলছে। রাতের আঁধারে তারা জাল ফেলে। অভিযান একটু কমলেই তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। হালদা পাড়ের মানুষ সচেতন না হলে এটা থামানো সম্ভব না।”

এরসাথে চলতি বছর নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হয়েছে মাছ ধরতে ‘বিষ’ (রাসায়নিকের) প্রয়োগ।

অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘ডিঅক্সিডাইজিং কেমিকেল’ ব্যবহার করে নদীর একটি নির্দিষ্ট অংশের পানিতে অক্সিজেন কমিয়ে ফেলা হয়। অক্সিজেনের অভাবে মাছ ভেসে উঠলে জাল দিয়ে সেগুলো টেনে নেয় চোরা শিকারীরা।

তার পরামর্শ, “হালদা পাড়ের মানুষ নিজেরা সচেতন এবং সক্রিয় হলেই চোরা শিকারীদের থামানো সম্ভব। সরকার স্থানীয়দের অর্ন্তভুক্ত করে বড় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করতে পারে যারা হালদা পাহারা দেবে।”

ইউএনও রুহুল আমীন বলেন, “হালদার দুই পাড়ের সাধারণ মানুষ, ডিম আহরণকারী, জনপ্রতিনিধি আর জেলেরা সচেতন হয়ে চোরা শিকারীদের ঠেকাতে তৎপর হলেই কেবল এই প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব।”