হালদায় একটি ডলফিন হত্যা

ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা একটি ডলফিন হালদা নদীতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 May 2020, 03:56 PM
Updated : 8 May 2020, 03:56 PM

শুক্রবার দুপুরে হাটহাজারী মদুনাঘাট সংলগ্ন অংশ থেকে ডলফিনটি উদ্ধার করা হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, রাতে হালদায় মা মাছ ধরতে পাতা ভাসা জালে ডলফিনটি আটকা পড়েছিল। পরে এটিকে ধারালো কিছু দিয়ে কেটে হত্যা করা হয়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত হালদায় ২৪টি ডলফিনের মৃত্যু রেকর্ড করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি।

তবে এই প্রথম কোনো ডলফিনের মৃতদেহে এভাবে ধারালো কিছুর গভীর আঘাত দেখা গেল।

নিহত ডলফিনটি পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি দীর্ঘ এবং এর ওজন প্রায় ৫২ কেজি।

বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষিত হালদা নদীতে এরকম নৃশংসভাবে ডলফিন হত্যা বিপন্ন প্রজাতিটির জন্য ‘অশনি সংকেত’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

শুক্রবার সকালে নদীর মদুনাঘাট সংলগ্ন অংশে ডলফিনটি ভাসতে দেখে মা মাছ পাহারায় নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয় প্রশাসনকে জানায়।

হাটহাজারীর জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা রনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জোয়ারের সময় নদীতে ভেসে আসা ডলফিনটি মদুনাঘাট অংশ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে সেটি নয়ারহাট এলাকায় মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।

তিনি বলেন, “ডলফিনটির মুখে জালের অংশবিশেষ লেগে ছিল। মাথার নিচে এবং শরীরের মাঝ বরাবর দুই পাশ থেকে লম্বালম্বিভাবে গভীর করে ডলফিনটির শরীর কাটা হয়। জালে আটকা পড়ার পর এটিকে ধারালো কিছু দিয়ে কেটে হত্যা করা হয়। ডলফিনটির গলার কাছে আরো একটি গভীর আঘাতের চিহ্ন ছিল।”

দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় এখন মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম। তাই নদীতে মা মাছের আনাগোনা বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে চোরা শিকারীদের উৎপাত।

চোরা শিকারীদের ঠেকাতে হালদার হাটহাজারী ও রাউজান অংশে নিয়মিত অভিযান চললেও তাদের তৎপরতা যে থামছে না।

নাজমুল হুদা বলেন, “এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ঘটনা। ডলফিন খুবই নিরীহ প্রাণি। নদীর যে অংশে পানির মান ভালো থাকে সেখানেই ডলফিন আসে। চোরা শিকারীরা হয়ত কোনো ধরনের কুসংস্কার থেকে ডলফিনটিকে কেটে হত্যা করেছে।”

জালে ডলফিন আটকালে আর মাছ ধরা পড়ে না বলে হালদা পাড়ে কুসংস্কার আছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৮ সালে করা জরিপে হালদায় ডলফিনের সংখ্যা ছিল দুইশটির মতো। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত মোট ২৪টি ডলফিন মারা গেল। গত ২১ মার্চ আরেকটি ডলফিন মারা গিয়েছিল আজিমের ঘাট এলাকায়।

“আজকেরটি একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ডলফিন। এ পর্যন্ত যত মৃত ডলফিন হালদায় পেয়েছি, কোনোটিকেই এভাবে হত্যা করা হয়নি। আগে নিহত বেশিরভাগ ডলফিন নৌযান ও বালু উত্তোলনকারী ড্রেজারের আঘাতে মারা গিয়েছিল।”

অধ্যাপক কিবরিয়া বলেন, “এটা অত্যন্ত নৃশংস ঘটনা এবং অশনি সংকেত। এভাবে ডলফিন হত্যার ধারণা যদি চোরা শিকারিদের মধ্যে ছড়ায় তাহলে হালদার ডলফিন রক্ষা কঠিন হবে। 

“হালদায় এখন মাছ ধরা নিষেধ। প্রজনন মৌসুম হওয়ায় মা মাছের আনাগোনা খুব বেশি। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চোরা শিকারীরা রাতে গোপনে নদীতে ভাসা জাল পাতছে।”

এই ডলফিনটি কেটে এর শরীর থেকে চর্বি শিকারিরা নিয়ে গেছে বলে ধারণা মনজুরুল কিবরিয়ার।

তিনি বলেন, ‘জালে আটকা পড়ায় এটিকে হত্যা করা হয়েছে। ডলফিনের শরীরে থাকা চর্বি থেকে এক ধরনের তেল তৈরি করে ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে ওই এলাকায় মিথ চালু আছে।

“যেভাবে কাটা হয়েছে, তা দেখে ধারণা করছি এটিকে ডাঙায় তুলে কাটা হয়েছে। তারপর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

হালদা নদীর হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকার বিপরীত পাশে রাউজান উপজেলার উড়কিরচর ইউনিয়নের মিয়ার বাজার এলাকা থেকে ডলফিনটি ভাসিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, “চোরা শিকারীদের ঠেকাতে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। হালদা পাড়ের বাসিন্দারা আরো সচেতন না হলে ডলফিন রক্ষা করা খুব কঠিন হবে।”

হালদা নদীতে যে ডলফিনের দেখা মেলে, তা গাঙ্গেয় ডলফিন প্রজাতির। ইংরেজিতে একে বলা হয় Ganges River Dolphin; এর বৈজ্ঞানিক নাম Platanista gangetica । স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় হুতুম বা ‍শুশুক।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গাঙ্গেয় ডলফিনকে বিপন্ন হিসেবে লাল তালিকায় রেখেছে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

এই প্রজাতির ডলফিন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের নদীতে দেখা যায়। এরমধ্যে ভারতের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র, বাংলাদেশের পদ্মা, সুন্দরবনের আশেপাশের নদী এবং চট্টগ্রামের হালদা ও কর্ণফুলী এর বিচরণ ক্ষেত্র।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার। হালদার সঙ্গে সংযুক্ত আছে ১৭টি খাল।

দখল, দূষণ এবং চোরা শিকারির তাণ্ডবে বিপন্ন হালদার মা মাছও।

এই সংক্রান্ত খবর-