করোনাভাইরাস: হালদাপাড়ে আশা-আশঙ্কার দোলাচল

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউনে দূষণ কমায় হালদায় এবার বেশি মাছের ডিম পাওয়ার আশা যুগিয়েছিল পোনা আহরণকারীদের মনে, তবে এই বৈরী পরিস্থিতিতে সেই ডিমের রেণু বিক্রি করতে পারবেন কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2020, 10:53 AM
Updated : 19 April 2020, 11:33 AM

দেশে কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে এবার বেশি ডিম পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

এর কারণ হিসেবে নদী দূষণকারী দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া, লকডাউনের কারণে নদী সংলগ্ন বিভিন্ন কারখানার দূষণ না থাকা, ড্রেজার চলাচল বন্ধ ও মা মাছের মৃত্যু তুলনামূলক কম হওয়ার কথা বলছেন তারা।

হালদায় অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে মৌসুমের প্রথম বা দ্বিতীয় ভারী বজ্রসহ বৃষ্টিতে (এপ্রিলের শেষ বা মে মাসে) পাহাড়ি ঢল নামলে এবং নদীর তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা অনুকূলে থাকলে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালাবাউশ জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে।

চলতি মাসের ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পূর্ণিমার ‘জো’ (স্থানীয়দের ভাষায়) থাকলেও বৃষ্টি হয়েছে হালকা। ১৮ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া অমাবস্যার জো চলবে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এই সময়েই মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে বলে মনে করছেন আহরণকারীরা।

চট্টগ্রামের অনন্য এই নদীর রাউজান ও হাটহাজারী অংশে নদীর আজিমের ঘোনা, অংকুরি ঘোনা, রাম দাশ মুন্সীর ঘাট, সত্তারঘাট, মাছুয়া ঘোনা, মাদার্শা, কাগতিয়া, গড়দুয়ারাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ডিম সংগ্রহ করা হয়।

গড়দুয়ারা এলাকার ডিম আহরণকারী কামাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নদীতে মা মাছের আনাগোনা অনেক। ভারী বৃষ্টি হলেই ডিম ছাড়তে পারে। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করি, ভালো ডিম পাব, কিন্তু সমস্যা আছে অনেক।

“ডিম সংগ্রহে সহায়তাকারী হিসেবে যারা নৌকায় কাজ করে তারা আশপাশের গ্রাম থেকে আসে। গাড়ি তো চলে না, রাত-বিরাতে তারা কীভাবে আসবে?”

নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ার পরই দ্রুততম সময়ে তা আহরণ করতে হয়। না হলে স্রোতের সাথে ডিম ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

হালদা পাড়ের বর্ষীয়ান ডিম আহরণকারী কামাল সওদাগর বলেন, “তারা না আসলে ডিম আহরণ কঠিন হবে। তাছাড়া রেণু পোনা কিনতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, রাজশাহী, বরিশাল, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৭ জেলার লোকজন আসে।

“ডিম যদি পাইও বিভিন্ন জেলার ক্রেতারা না আসলে বিক্রি করব কার কাছে? নারায়ণগঞ্জের এক নিয়মিত ক্রেতা যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু সেখানে করোনাভাইরাসে মানুষ মারা যাচ্ছে। তিনি আসতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।”

তিনি বলেন, “চট্টগ্রামে পোনা বিক্রি হয় তবে সেটা তুলনামূলক কম। অন্য জেলার ক্রেতা না আসলে আমরা পথে বসবো। হয় করোনাভাইরাস চলে যাক, না হলে মাছ আরও কয় দিন পর ডিম ছাড়ুক। এখন এই দোয়া করতেছি।”

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার এটাই সমস্যা। এই সময়ে মা মাছ ডিম ছাড়লেও পোনা কিনতে ক্রেতারা কীভাবে আসবে, আসলেও কতজন আসবেন?

“তবে এবার এশিয়ান পেপার মিল ও হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ থাকায় নদীতে দূষণ অনেক কম হয়েছে। লকডাউনের কারণে অক্সিজেন ও কুলগাঁও এলাকার অনেক কারখানা বন্ধ। এতে দূষণ আরও কমেছে। পাশাপাশি বালুর ড্রেজার চলাচল বন্ধ এবং উজানে তামাক চাষও অনেকটা কম। এ বছর মা মাছ তেমন মারা যায়নি। তাই আশা করছি, পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে গতবারের চেয়ে বেশি ডিম পাওয়া যাবে।”

মাদার্শা এলাকার আরেক ডিম আহরণকারী আশু বড়ুয়া বলেন, “এই অমাব্যসার জো তে ভারী বৃষ্টি হলেই আমরা নদীতে যাব। কিন্তু এ অবস্থায় রেণু কেনার মতো লোক পাওয়া মুশকিল।

“নিজেদের যে দুয়েকটা পুকুর আছে সেগুলো তৈরি করতেছি। কিন্তু তাতে আর কত পোনা ধরবে? খুব চিন্তায় আছি।”

এর সাথে যোগ হয়েছে রাতের আঁধারে হালদায় চোরা শিকারির হানা।

আশু বড়ুয়া বলেন, “রাতে রাতে জাল বসিয়ে মাছ ধরতেছে। প্রশাসন কয় জায়গায় যাবে? এভাবে হলে ডিমও আদৌ কতটুকু পাব জানি না।”

শনিবার রাত পৌনে ১১টায় হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নের কান্তজার বাজার এলাকায় বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেই নদীতে মাছ শিকারে নামে ৩০ জনের চোরা শিকারিদের একটি দল।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হালদায় বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে এমন খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যাই। রাস্তা থেকে নদীর পাড় ধরে এগিয়ে যাওয়ার ফাঁকেই তারা জাল ফেলে পালিয়ে যায়।

“পাঁচশ মিটার জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। এ বছর শতাধিক অভিযানে লক্ষাধিক মিটার জাল ধ্বংস করা হয়েছে। অভিযান চলবে।”

রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজও (রোববার) হালদায় আমাদের অভিযান চলবে।”

এদিকে ডিম আহরণের পর রেণু পোনা ফোটাতে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা, শাহমাদারি ও মাছুয়াঘোনা এবং রাউজান উপজেলার মোবারক খিল ও পশ্চিম গহিরার মোট পাঁচটি সরকারি হ্যাচারির ১৬৭টি কুয়া প্রস্তুত করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

পাশাপাশি স্থানীয়দের আরও শতাধিক কুয়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।

পোনার ক্রেতাদের আসা-যাওয়ার বিষয়ে হাটহাজারীর ইউএনও রুহুল আমিন বলেন, কেউ যোগাযোগ করলেই তাদের প্রত্যয়নপত্রসহ পোনা পরিবহনে সব রকমের সুবিধা দেওয়া হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে কাঁচাবাজারের মতো রেণুর বাজারও পরিচালনা করা যাবে।

রাউজান উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মৎস্য খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট পণ্য পরিবহন বিধি-নিষেধের আওতামুক্ত বলে জানানো হয়েছে। বিষয়টি দেশের সব স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।

“প্রয়োজনে রেণু ক্রেতাদের চলাচলের সুবিধার্থে আমরাও জানিয়ে দিব।”

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৫ মে ডিম ছাড়ে হালদার মা মাছ। আহরণ করা প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে ২০০ কেজির কিছু বেশি রেণু উৎপাদিত হয়েছিল, যার বাজার মূল্য প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা।

২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ; সংগ্রহ করা হয় ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম। উৎপাদিত রেণু ছিল ৩৭৮ কেজি, যার বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা।