দূষণ কমাতে প্লাস্টিক বর্জ্যে রাস্তা নির্মাণের পরামর্শ

এই প্রক্রিয়াকে পরিবেশবান্ধব ও ইতিবাচক সমাধান হিসাবে দেখছেন গবেষকরা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Sept 2022, 02:53 PM
Updated : 10 Sept 2022, 02:53 PM

পরিবেশ দূষণে কমাতে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণের বিকল্প উপকরণ হিসাবে ব্যবহারের পরামর্শ এসেছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এক গবেষণায়।

নগরীতে পলিথিন ব্যবহারের পরিমাণ, পরিবেশের উপর প্রভাব এবং পরিত্রাণের উপায় নিয়ে ওই গবেষণায় এই প্রক্রিয়াকে পরিবেশবান্ধব ও ইতিবাচক সমাধান হিসাবে দেখছেন গবেষকরা।

শনিবার চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ ও বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তারা।

পুরকৌশল বিভাগের পিয়াল বড়ুয়া ও আল আমিন নামে দুই শিক্ষার্থী প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য নিয়ে ওই গবেষণা পরিচালনা করে সমাধানের পথ তুলে ধরেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে চুয়েটের সাবেক উপাচার্য ও চট্টগ্রাম ওয়াসার চেয়ারম্যান অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পলিথিন উৎপাদন বন্ধে আইন কার্যকরে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। উৎপাদন না হলে ব্যবহারও হবে না।

“এখন এই শহরের সব পলিথিন কর্ণফুলীতে যায়। ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হলে তখন ৬০ ফুট পলিথিনের স্তর পাওয়া গেল।

“পলিথিন বর্জ্যের কারণে কর্ণফুলী মৃতপ্রায়। এ নদী না বাঁচলে চট্টগ্রাম শহরও মারা যাবে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) উচিত পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য পৃথক করে সংগ্রহ এবং রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করা।”

পলিথিন ব্যবহার, প্রভাব ও পরিত্রাণ নিয়ে ওই সমীক্ষা অনুসরণে সিসিসিকে আহ্বান জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, “প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য বিকল্প হিসেবে রাস্তা নির্মাণে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে। পরবর্তীতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সারাদেশে এর প্রয়োগ করতে পারবে।”

সংবাদ সম্মেলনে চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত বলেন, “মডিফাইড বিটুমিন (প্লাস্টিক বিটুমিনাস রোড) ব্যবহারে সড়কের স্থায়িত্ব বেড়ে যাবে। ভারী যানবাহন সড়কের তেমন ক্ষতি করতে পারবে না।

“প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যবহারে সড়কের তাপ সহনশীলতা বাড়বে এবং পানির সঙ্গে ডিবন্ডিং হয় না বলে বৃষ্টিতে ক্ষতি কমে সড়কের স্থায়িত্ব বাড়াবে।”

সড়ক নির্মাণে প্লাস্টিক ব্যবহারে খরচও কমতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “দুই লেইনের (৩.৫ মিটার প্রস্থ) এক কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৭৫ মিলিমিটার পুরুত্বের একটি সড়কে বিটুমিনের সঙ্গে সাড়ে ৭ শতাংশ ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার করলে ২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে।”

সিসিসির হিসাবের বরাতে স্বপন কুমার বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে দিনে যত বর্জ্য হয় তার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক-পলিথিন। এগুলো অপচনশীল হওয়ায় পরিবেশকে নানাভাবে দূষিত করছে।

“যেহেতু সরকারি সংস্থাগুলো পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে পারছে না, তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে। এজন্য বিকল্প হিসেবে সড়ক তৈরিতে কীভাবে এর ব্যবহার করা যায় সে প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। ”

সমীক্ষা পরিচালনাকারী চুয়েট শিক্ষার্থী পিয়াল বড়ুয়া জানান, শিল্প কারখানা, বাণিজ্যিক ব্যবহার, কৃষি খামার এবং গৃহস্থালি, এই চারটি প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যের মূল উৎস। চট্টগ্রাম প্লাস্টিক-পলিথিন রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধিত এ ধরনের বর্জ্য সংগ্রহকারী ৩০০টি দোকান বা প্রতিষ্ঠান আছে নগরীতে। এর মধ্যে ৭৫টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে সমীক্ষাটি চালানো হয়।

সমীক্ষা পরিচালনাকারী আরেক শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, “৭৫টি দোকান ২৭ দশমিক ২৫ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে দিনে। এর মধ্যে রিসাইক্লিং যোগ্য ২২ টনের মত।

“৭৫টি দোকানের অনুপাতে ৩০০ দোকানে দিনে মোট সংগৃহীত প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য হয় ১০৯ টন। তার মানে ১৪০ টন বর্জ্য অসংগৃহীত থাকে।”

আল আমিন বলেন, “চুয়েট এর রিসার্চ লেকচারার মেহেদী হাসান মামুন ২০১৮-১৯ সালে এক গবেষণায় দেখান, বন্দর নগরীতে দিনে উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ প্লাস্টিক-পলিথিন। সিসিসির হিসাবে দিনে মোট বর্জ্য হয় ৩ হাজার টন। সে হিসাবে নগরীতে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য দিনে ২৪৯টন।”

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সমীক্ষায় ইন্টারমেন্টাল ইনক্রিস মেথডে (আইআইএম) দেখা গেছে, বর্তমানে বন্দর নগরীতে ৫২ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে ২৪৯ টন প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য হয় দিনে। ২০৩২ সালে ৬২ লাখ এবং ২০৪২ সালে জনসংখ্যা বেড়ে হতে পারে ৭৩ লাখ।

“এই হারে চলতে থাকলে সবশেষ ২০৫২ সালে সাড়ে ৮৫ লাখ জনসংখ্যা ৪২৮ টন প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য উৎপাদন করবে।”

পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, প্লাস্টিক-পলিথিন আমাদের বিনাশ ডেকে আনবে। মাইক্রো পলিথিন সামুদ্রিক প্রাণী, সমুদ্র ও নদীর মাছের মাধ্যমে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। যা ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

সংবাদ সম্মেলনে নদী গবেষক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, পলিথিনের কারণে নদী, নালা, খাল ও প্রাণিকূল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০১ সালে আইন হলেও এর প্রয়োগ যথাযথ হয়নি। আত্মঘাতী কাজ করছি। পরিবেশ ও প্রাণিকূলের জীবন বিপন্ন। সাগর ও নদী দূষণ হচ্ছে। আমাদের কর্ণফুলী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। সচেতন না হলে পলিথিনেই বিনাশ হবে আমাদের।

“কর্ণফুলীতে বহু স্তরে পলিথিন জমেছে। সব বুঝেও আমরা নির্লিপ্ত উদাসীন। সব দৈনন্দিন কাজ করলেও আমরা পলিথিন বন্ধে আগ্রহী না। বাঁচতে হলে অস্তিত্ব রক্ষায় পলিথিন থেকে সরে আসতে হবে। পাটের ব্যবহারে ফিরতে হবে।”

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের নেতৃবৃন্দ, সহযোগী অধ্যাপক মনোজ কুমার দেব, প্রদীপ কুমার দাশ ও এস এম পেয়ার আলী উপস্থিত ছিলেন।