শখের বশে এ আয়োজনে সম্পৃক্ত হন অনেকেই।
Published : 25 Apr 2023, 09:28 PM
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুব সমাজকে সংগঠিত করতে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে আব্দুল জব্বার সওদাগর যে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন, কালের পরিক্রমায় তা হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামবাসীর ঐতিহ্য।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এই খেলা, আর খেলা ঘিরে তিনদিন ধরে লালদীঘির মাঠ ও আশপাশের কয়েক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসে বৈশাখী মেলা।
এ বছর বসে এ কুস্তি প্রতিযোগিতার ১১৪তম আসর। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে দুই বছর বলী খেলা বন্ধ থাকে; গতবছর তা পুনরায় শুরু হয়।
চট্টগ্রামবাসীর ঐতিহ্য এ বলী খেলায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে অংশ নেন প্রতিযোগীরা, যাদের অনেকেই শখের বশে আসেন এ কুস্তি প্রতিযোগিতায়। কিশোর থেকে বৃদ্ধ– নানা বয়সী মানুষ শখের বসে অংশ নেন এ প্রতিযোগিতায়।
এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। নানা বয়সী ৬০ প্রতিযোগী এবার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
লালদীঘি মাঠে এবারের আসরের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়। খেলা শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম।
প্রতিবারের মত এবারও অংশ নেন হাটহাজারীর সত্তরোর্ধ্ব মফিজ এবং পতেঙ্গার খাজা আহম্মদ। তবে আগামীতে আর অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন খাজা আহম্মদ।
তাদের ভাষ্য, পাঁচ দশক ধরেই তারা আব্দুল জব্বারের বলী খেলায় অংশ নিয়ে আসছেন। এ বছর দুই ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আহম্মদ বলেন, “কিশোর বয়স থেকেই এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আসছি। বয়স হয়ে গেছে, আগামী বছর থেকে আর খেলব না। তবে আমার দুই ছেলে অংশ নেবে।“
তিন ছেলে এক মেয়ের জনক খাজার বড় ও মেজ ছেলে খেলায় অংশ নিয়েছেন।
খাজা আহম্মদ তার সমবয়সী মফিজের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে দুই বয়োবৃদ্ধর খেলায় কেউ জেতেনি, কেউ হারেনি। রেফারি তাদের দুই জনকেই যুগ্মভাবে জয়ী ঘোষণা করেন।
এদিকে খাজার ছোট ছেলে কাইয়ুম জয়ী হতে না পারলেও বড় ছেলে সেলিম দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলেছেন। গতবারের চ্যাম্পিয়ন জীবন বলীর কাছে পরাজিত হয়ে বিদায় নেন তিনি।
সেলিম জানান, কর্ণফুলী ইপিজেডে একটি পোশাক কারখানায় টেকনিশিয়ান হিসেবে তিনি কর্মরত। তার ছোট ভাইও সম্প্রতি সেখানে যোগ দিয়েছেন।
শখের বসে খেলতে এলেও দুই মাস ধরে তারা অনুশীলন করেন। তাদের সঙ্গে এসেছেন তাদের এক চাচাত ভাই মো. রিমন।
পেশায় গাড়ি চালক রিমন জানান, তারা এক পরিবারের চারজন অংশ নিয়েছেন এ বছর। তাদের মধ্যে তিনি ও কাইয়ুম এ বছরই প্রথম।
তিন ভাই ও চাচা মিলে তারা অনুশীলন করেন বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন বয়সী ও পেশার লোকজনের সাথে আসা কলেজ পড়ুয়া রাকিবের সঙ্গে কথা হল। নগরীর ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের এ শিক্ষার্থী জানান, তিনি এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে অংশ নেবেন।
চট্টগ্রামে থাকলেও তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেলেও বলী খেলায় অংশ নিতে তিনি আগেই বাড়ি থেকে চলে এসেছেন।
এ বছরের ১১৪তম আসরে প্রথম রাউন্ড শেষে আব্দুল নূর, মো. মুছা, মো. সেলিম, মো. রুবেল ও আমীর হোসেনকে গতবারের প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী তারেকুল ইসলাম জীবন, শাহজালাল ও সৃজন চাকমার সাথে সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার সুযোগ করে দেয় কমিটি।
তাদের মধ্যে মুছাকে পরাজিতে করে আব্দুল নূর, রুবেলকে পরাজিত করে শাহজালাল, সেলিমকে পরাজিত করে জীবন এবং আমীর হোসেনকে পরাজিত করে সৃজন চাকমা ওঠেন সেমিফাইনালে।
আর সেমিফাইনালে আব্দুল নূরকে পরাজিত করে শাহজালাল এবং সৃজন চাকমাকে পরাজিত করে চকরিয়ার জীবন ফাইনালে ওঠেন ।
তবে ফাইনালে অসুস্থতার কথা বলে জীবন কুমিল্লার শাহজালালকে ছেড়ে দিলে, রেফারি শাহজালালকে জয়ী ঘোষণা করেন।
তিন দশক ধরে খেলা পরিচালনা, এখন অবসর
তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঐতিহাসিক বলী খেলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল মালেক।
২০১৩ সাল পর্যন্ত টানা তিন বার কাউন্সিলর থাকলেও মালেকের অন্য পরিচয় ছিল বলী খেলার রেফারি হিসেবে।
এ বছর খেলার মঞ্চে নিজের অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন আব্দুল মালেক।
মালেক ছাড়াও এবছর খেলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ৯০ দশকের টানা তিন বারের চ্যম্পিয়ন সিদ্দিক আহমেদ, জাহাঙ্গীর আলম ও বক্সিরহাট ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জামাল হোসেন।
স্থানীয় সওদাগর আব্দুল জব্বার ১৯০৯ সালে প্রথমবার এ কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন লালদীঘি মাঠে। পরে তা আব্দুল জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিত হয়, যার জনপ্রিয়তা এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।