এমভি আবদুল্লাহ: নাবিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগে মালিকপক্ষ

“তাদের সুস্থ ও নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হাঁটছি,” মালিকপক্ষের মুখপাত্র।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2024, 05:48 PM
Updated : 19 March 2024, 05:48 PM

সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি এমভি আবদুল্লাহ এর নাবিকদের সঙ্গে জাহাজটির মালিকপক্ষের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তবে জলদস্যুদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কথাবার্তার যোগসূত্র তৈরি হয়নি; মুক্তিপণ কিংবা অন্য কোনো দাবি নিয়েও তারা হাজির হয়নি। বন্দি নাবিকদের কাছ থেকেই তাদের বিষয়ে কিছুটা জানা যাচ্ছে।

মঙ্গলবারও জিম্মি নাবিকদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপের বরাতে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজটির মালিক পক্ষ কবির গ্রুপের মুখপাত্র বলেছেন, নাবিকরা সবাই সুস্থ আছেন। শারীরিক কোনো অসুবিধার তথ্য তারা দেননি। তাদের মানসিকভাবে শক্ত থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জাহাজে খাবার বা পানীয় সংকট নেই বলেও জানিয়েছেন নাবিকরা।

কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পার্সন মিজানুল ইসলাম বলেন, “আমরা তাদের মানসিকভাবে শক্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছি এবং আশ্বস্থ করেছি তাদের সুস্থ ও নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হাঁটছি।“

অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত করাই তাদের লক্ষ্য বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তুলে ধরেন তিনি।

সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে জাহাজটি মুক্ত করতে আন্তর্জাতিকভাবে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার মধ্যে মালিকপক্ষের এই মুখপাত্র বলেন, নাবিকদের ‘নিরাপত্তা’র কথা বিবেচনা করে তারা কোনো সামরিক অভিযানে সমর্থন দিতে চান না।

সরকারও তেমনটি চায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জাহাজটিতে বন্দি ২৩ নাবিকের একজন এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান। মঙ্গলবার তার ভাই আসিফ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শনিবারের পর থেকে আর আমাদের সাথে ভাইয়ের যোগাযোগ হয়নি।

“মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা এমভি আবদু্ল্লাহ উদ্ধারে অভিযানের প্রস্তুতি বিষয়ে জেনেছি। আমরা কোনো সহিংসতা চাই না। আমরা চাই তারা নিরাপদে ফিরে আসুক।”

এর আগে ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তায় থাকা ইউরোপীয় বাহিনী আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশ সরকার তাতে সায় দেয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে আলোচনায় জানিয়েছিলেন।

চট্টগ্রামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এস আর শিপিং লাইনের একটি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। ওই জাহাজের ২৩ নাবিকের সবাই বাংলাদেশি।

এক দশক আগে জলদস্যুদের কবলে পড়া ‘এমভি জাহান মনি’ জাহাজটির মালিকও কবির গ্রুপ। নানাভাবে দর কষাকষি করে তিন মাস পর সেই জাহাজ ও জিম্মি নাবিকদের দেশে ফেরানো হয়েছিল সে সময়।

তখন মুক্তিপণের বিষয়টি প্রকাশ্যে উল্লেখ করা না হলেও লেনদেনের ভিত্তিতেই নাবিক ও জাহাজটি মুক্ত হয়েছিল। সেসময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে প্রায় সাড়ে ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তখন জাহাজটি মুক্ত করা হয়েছিল দস্যুদের কবল থেকে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বুধবার দুপুরে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এমভি আবদুল্লাহ ও ২৩ নাবিককে উদ্ধারের জন্য ‘সেকেন্ড পার্টির মাধ্যমে’ সোমালি জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।

সেই সেকেন্ড পার্টি কারা, তা স্পষ্ট না করলেও তিনি বলেছেন, “ইতোমধ্যে রিপোর্টিং সেন্টার ইন কুয়ালালামপুর, ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার ইন নিউ দিল্লি, তারপর সিঙ্গাপুর, ইউএসএ, ইউকে, চায়নাসহ সকল এরিয়াল নেভাল শিপে জানানো হয়েছে। অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।”

মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে।

জাহাজটি আট দিন ধরে জলদস্যুদের কবলে থাকলেও এখনও কোন ধরনের যোগাযোগের পথ খুঁজে পায়নি মালিকপক্ষ। জলদস্যুদের পক্ষ থেকেও কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। বীমা কোম্পানির মাধ্যমে দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টাও সফল হয়নি। এরমধ্যে জাহাজটি নিয়ে কয়েকবার অবস্থান পাল্টেছে জলদস্যুরা।

ভারতীয় নৌবাহিনী সোমালি জলদুস্যদের অপর একটি দলের হাতে আটক মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ রুয়েন উদ্ধার করলে এমভি আবদুল্লাহয় থাকা দস্যুরা সতর্কতার অংশ হিসেবে সোমালি উপকূলে অবস্থান পাল্টেছে। আটক জাহাজে জলদস্যুদের সংখ্যাও বেড়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

এদিকে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটি এবং জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দেশটির পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশের বরাতে রয়টার্সে খবর এসেছে।

সোমবার রয়টার্স এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আবদুল্লাহয় অভিযানের এই পরিকল্পনা করা হয়েছে।

পান্টল্যান্ড সোমালিয়ার একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, যেখানে অনেকগুলো জলদস্যু দলের ঘাঁটি রয়েছে। ওই এলাকার পুলিশ বাহিনী বলেছে, এমভি আবদুল্লাহকে দখল করে থাকা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে। সে কারণে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতেও প্রস্তুত রয়েছে।

এর আগে রোববার এমভি আবদুল্লাহ দখল করে রাখা জলদস্যুদের জন্য ‘খাত’ নামের এক ধরনের মাদক নিয়ে যাওয়ার সময় একটি নৌযান জব্দ করার কথা জানিয়েছিল পান্টল্যান্ড পুলিশ।

এছাড়া আবদুল্লাহকে জলদস্যুদের যে দলটি দখল করেছে সেই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তারও করেছে স্থানীয় পুলিশ।

শনিবার সোমালি উপকূলে ৪০ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে এমভি রুয়েনকে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করেন ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডোরা। জাহাজটির ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পাশাপাশি জাহাজে থাকা ৩৫ জলদস্যুর সবাইকে তারা আটক করেন।

তিন মাস আগে আরব সাগরে মাল্টার পতাকাবাহী ওই জাহাজ দখল করে নেওয়ার পর নাবিকদের জিম্মি করে জলদস্যুরা। এরপর ওই জাহাজ ব্যবহার করে বিভিন্ন নৌযানে তারা হামলা চালাতে থাকে।

বাংলাদেশের জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে ছিনতাইয়ের সময়ও জলদস্যুরা এমভি রুয়েনকে ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সের ধারণা।

ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস তর্কশ গত বৃহস্পতিবার সকালে এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছেছিল। কিন্তু নাবিকরা সশস্ত্র জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকায় সে সময় অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকেন ভারতীয় নৌ সেনারা।

পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে জলদস্যুতা নির্মূলে কাজ করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সও তাদের ‘অপারেশন আটলান্টার’ অংশ হিসেবে এমভি আবদুল্লাহর ওপর নজর রাখছে।

আরও পড়ুন

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: ‘অভিযানের প্রস্তুতি’ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক বাহিনী

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: ‘জোরপূর্বক’ উদ্ধারে ইইউর প্রস্তাবে বাংলাদেশের ‘না’

Also Read: ৪০ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানে কাবু জলদস্যুরা, উদ্ধার এমভি ‘রুয়েন’

Also Read: জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি, ‘প্রস্তাবও’ আসেনি

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: বীমা কোম্পানির মাধ্যমে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ১২ দস্যু, এখনো ‘অপারেশন আটলান্টার’ নজরে

Also Read: অবস্থান বদলেছে আবদুল্লাহর, বেড়েছে জলদস্যুর সংখ্যা

Also Read: ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে সোমালি জলদস্যুদের গুলি

Also Read: জাহাজের নিরাপত্তায় নিয়ম কী? এমভি আবদুল্লাহ কতটা মেনেছে?