বাংলাদেশ ভালো খেলেছে, কোচ কেন বরখাস্ত: সৌরভ

ভারত-নিউ জিল্যান্ড সেমি-ফাইনাল ম্যাচ শেষের পর তখন বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে। ম্যাচের পর টিভিতে বিশ্লেষণ পর্ব শেষ করে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। এগিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইতেই সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক বলে উঠলেন, “তোমাদের কি হলো বলো তো, কোচকে বরখাস্ত করে দিলে! বাংলাদেশ ভালো খেলেছে তো, কোচ কেন বরখাস্ত!”

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিম্যানচেস্টার থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2019, 06:11 AM
Updated : 11 July 2019, 11:19 AM

সৌরভের কথার উত্তর দেওয়ার শুরুই অবশ্য করা গেল না। তার আগেই শুরু হয়ে গেল সেলফি শিকারিদের ভিড়। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ম্যাচ শেষ হলেও দর্শকদের অনেকেই তখনও অপেক্ষায়, তারকাদের যদি একটু নাগালে পাওয়া যায়। সৌরভকে দেখে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ‘দাদা একটু এদিকে তাকাও’, ‘দাদা, এবার এদিকে..’, ‘দাদা, একট ছবি প্লিজ’, চারপাশে থেকে অনুরোধের স্রোত। ঘিরে ধরা শতশত মানুষ আর ক্যামেরার ভিড়ে তিনিই প্রায় হারিয়ে গেলেন!

নিরাপত্তাকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছিলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। অবস্থা বেগতিক দেখে পার্কিংয়ের দিকে ইশারা করে নিজে থেকেই বললেন, “ওখানে অপেক্ষা করো, আসছি।” ভক্তদের আবদার মিটিয়ে যখন ফিরলেন, তখন দেখা গেল তার অনেক তাড়া। ফিরতে হবে লন্ডনে। গাড়িতে ওঠার আগে কিছুক্ষণ কথা অবশ্য বলে গেলেন।

কোচকে দিয়ে আবার শুরু হলো কথা। তার সত্যিই কৌতূহল, বাংলাদেশ কেন স্টিভ রোডসকে আর কোচের দায়িত্বে রাখছে না। ‘ব্যর্থ বিশ্বকাপ অভিযানের বলি...’, উত্তরটা দেওয়ার শুরু করতেই মুখে কথা কেড়ে নিলেন সৌরভ, “ব্যর্থ বলছো কী! তোমরা ভালো করেছো তো। আমি কেন, এখানে সবাই প্রশংসা করছে। এভাবে কোচ বাদ দেওয়া মোটেও ভালো সংস্কৃতি নয়।”

সৌরভের এই কথা অবশ্য সত্যি, প্রশংসা এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যথেষ্টই পেয়েছে। কিন্তু শুকনো প্রশংসায় তৃপ্ত হওয়ার দিন তো বাংলাদেশের ক্রিকেট বেশ আগেই পেরিয়ে এসেছে! দিনশেষে ফলাফলটা বড় ব্যাপার, বাংলাদেশ পয়েন্ট টেবিলে অষ্টম, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি মেলেনি, এসব বিস্তারিত বলার পর একটু গম্ভীর হয়ে কিছু ভাবলেন। খানিক পর জানালেন, কোন জায়গাটায় বাংলাদেশের উন্নতি সবচেয়ে জরুরি।

“বড় টুর্নামেন্টে চাপের মুহূর্তগুলো জিততে শিখতে হবে। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় নার্ভ ধরে রাখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলি যারা জিততে পারে, ম্যাচও তারা জেতে। বাংলাদেশ এবার বেশ কয়েকটি ম্যাচে ওই সময়গুলো নিজেদের পক্ষে আনতে পারেনি।”

“মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। আজকে দেখেছো, জাদেজা ও ধোনির জুটির সময়ও নিউ জিল্যান্ড একটুও হাল ছাড়েনি। সবসময় বিশ্বাস করেছে তারা জিতবে। চেষ্টা করে গেছে এবং ফল পেয়েছে। এই মানসিকতা না থাকলে নিয়মিত জেতা সম্ভব নয়।”

সেই হার না মানা মানসিকতা নিয়ে বলার জন্য সৌরভের চেয়ে উপযুক্ত লোক কমই আছে। ভারতীয় ক্রিকেটের পালাবদলের শুরু তার হাত ধরে। তিনি অধিনায়ক হওয়ার পর বদলে দিয়েছিলেন ভারতীয় দলের চিরায়ত চরিত্র। অধিনায়ক সৌরভই শিখিয়েছিলেন, মাঠের ক্রিকেটে যেমন, তেমনি শরীরী ভাষায়ও প্রতিপক্ষকে কাবু করা যায়। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো দেশে এসে তাদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা যায়। সেসবের প্রতিফলন দিনশেষে পড়ত ম্যাচের ফলে।

এই মানসিকতা পোক্ত করার প্রাথমিক একটি সূত্রের কথা বললেন সৌরভ, “বিশ্বাস। নিজের ওপর, নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। এবং নিজের ওপর তোমার ভরসা যে প্রবল, সেটি ফুটিয়ে তুলতে হবে।”

বাংলাদেশ এবার সেটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে কমই। তবে একজন পেরেছেন দারুণভাবে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ড নৈপুণ্যে এবার নিজেকে নতুন উচ্চতায় তুলে নিয়েছেন সাকিব। বাংলাদেশের ক্রিকেটকেও এনে দিয়েছেন সম্মান ও গৌরব।

এই সাকিবকে দেখে মুগ্ধ সৌরভও। তবে দাবি করলেন, ৬০৪ রান আর ১১ উইকেটের যুগলবন্দী দেখে অবাক হননি তিনি।

“সাকিব দারুণ খেলেছে। ছেলেটা এত ভালো খেলেছে বলেই বিশ্বকাপে সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। চমকে যাইনি ওর পারফরম্যান্সে। ও তো বরাবরই ভালো ক্রিকেটার। এবার হয়তো বিশ্বকাপে এত ভালো খেলেছে বলে অনেকের চোখে পড়েছে।”

দাপুটে পারফরম্যান্সে একটি সিরিজ প্রায় একার করে নেওয়ার নজির একবার দেখিয়েছিলেন সৌরভও। নব্বই দশকের শেষভাগে কানাডার টরোন্টোতে ভারত-পাকিস্তান চারটি ওয়ানডে সিরিজ হয়েছে পরপর চার বছর। ১৯৯৭ সিরিজে ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সৌরভ ম্যান অব দা ম্যাচ হয়েছিলেন টানা চার ম্যাচে।

সিরিজটি মনে পড়ে সৌরভেরও। তবে এগিয়ে রাখলেন সাকিবকেই, “ওই সিরিজ কী আর ভোলা যায়! খুব মনে পড়ে। তবে সাকিব তো বিশ্বকাপের মতো জায়গায় এতগুলো দলের বিপক্ষে টানা ভালো করেই গেল। এটা অনেক বড় ব্যাপার।”

কোচের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছিল কথোপকথন, শেষ হলো কোচ দিয়েই। নিউ জিল্যান্ডের কাছে হেরে ভারত ছিটকে গেছে বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে। ভারতের কোচ রবি শাস্ত্রীর ভূমিকাও হয়তো এখন খতিয়ে দেখা হবে। সৌরভ একসময় বেশ কয়েকবার বলেছেন, জাতীয় দলের কোচ হওয়ার স্বপ্নের কথা।

এখনও কি সেই স্বপ্ন আছে? মুচকি হাসিতে মাথা নেড়ে গাড়িতে উঠে গেলেন সৌরভ। এখন তিনি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের প্রেসিডেন্ট। কোচিং করানোর বাস্তবতা হয়তো নেই আপাতত। গাড়ি চলতে শুরু হওয়ার আগে কেবল বললেন, “ওসব আপাতত ভাবছি না, যেভাবে চলছে চলুক!”