গত চার বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় তুলেছে এই দল। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল হয়ে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি-ফাইনাল, ২০১৮ এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে দল। দেশের মাটিতে এসেছে একের পর এক সিরিজ জয়ের সাফল্য। দেশের বাইরেও এসেছে জয়, সিরিজ জয়। সাফল্যের পথ ধরেই এগিয়ে গেছে দল। সেই সাফল্যই স্বপ্ন দেখিয়েছে বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালের। ক্রিকেটারদের চোখেই স্বপ্ন দেখেছে সমর্থকরা। আস্থা রেখেছে সামর্থ্যে। পূরণ হলো না সেই স্বপ্ন।
স্বপ্ন পূরণ না হওয়া মানে অবশ্যই ব্যর্থতা নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযানকে ব্যর্থ বলা যায়, লক্ষ্যটুকু পূরণ করতে না পারায়। সামর্থ্যের পুরোটা দেখাতে না পারায়। পয়েন্ট টেবিলের তলানির ভাগে থাকায়।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দারুণভাবে শুরু করা বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এরপর হারাতে পেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটিতে জয় ছিল প্রত্যাশিত, ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। সেটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানকে হারানোর সুযোগ ছিল নিজেদের হাতেই। সেটি পারেনি দল।
এমনিতে এই আসর থেকে প্রাপ্তি কিছু আছে। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অবশ্যই সাকিব আল হাসানের অতিমানবীয় পারফরম্যান্স। আরও বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই তিনি বলা যায় বাংলাদেশের সবসময়ের সেরা ক্রিকেটার। গত ১০ বছর ধরে বেশির ভাগ সময় ছিলেন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ অলরাউন্ডার। কিন্তু বিশ্ব আসরে নিজের শ্রেষ্ঠত্বে ছাপ রাখার ব্যাপার হয়তো ছিল। সাকিব যেভাবে পারলেন, সেটি অনেকের কল্পনাকেও হয়তো ছাড়িয়ে গেছে। একজনের কাছ থেকে এমন অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স বিশ্বকাপ আর দেখেনি।
বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচটির আগে মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে ভালো ব্যাটিং করে গেছে দল। নিজেদের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছাড়িয়েছে দুইবার। গড়েছে রান তাড়ার রেকর্ড। বিরুদ্ধ কন্ডিশনে সত্যিকারের বিশ্বমানের দলগুলির সঙ্গে অন্তত ব্যাটিং দিয়ে পাল্লা দেওয়ার নিদর্শন দল রাখতে পেরেছে।
কিন্তু বোলিং, বিশেষ করে নতুন বলের বোলিং দলকে ভুগিয়েছে প্রবলভাবে। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন টুর্নামেন্ট জুড়ে। বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে বোলারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দীর্ঘ উইকেটখরা এসেছে এই টুর্নামেন্টেই। দুই পায়ে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে চেষ্টা করে গেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ, কিন্তু এবার আর চোট জয়ের গল্প রচনা করতে পারেননি।
সাইফ উদ্দিন নিয়মিত উইকেট নিলেও রান দিয়েছেন প্রচুর। রুবেল হোসেন বাইরে বসে থাকায় আলোচনা হয়েছে প্রচুর। প্রথম সুযোগে ৯ ওভারে ৮৩ রান দেওয়ার পর আর জোর দাবি জানাতে পারেননি। সাকিব ও মিরাজের স্পিন অবশ্য ছিল বেশ কার্যকর। কিন্তু পেসারদের ধারহীন বোলিংয়ে স্পিনাররাও খুব প্রভাব ফেলতে পারেননি।
বাংলাদেশ দলে কোনো গতিময় পেসার নেই, উইকেটশিকারি স্পিনার বা লেগ স্পিনার নেই, এই বাস্তবতা জেনেই ইংল্যান্ডে এসেছিল দল। কাজটা কঠিন, জানাই ছিল। কিন্তু নিজেদের সামর্থ্যের পুরোটা দেখাতে না পারাই হতাশার।
এবারের আগে ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপেও তিনটি করে ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। তবে ২০০৭ সালের সাফল্যে কাঁটা হয়ে আছে আয়ারল্যান্ডের কাছে হার, ২০১১ সালে আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৮ রানে অলআউট হওয়ার যন্ত্রণা। ২০১৫ বিশ্বকাপে তিন জয়ের দুটি স্কটল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে। এবার সেদিক থেকে পুরো টুর্নামেন্ট বিচার করলে হয়তো বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক বিশ্বকাপ। কিন্তু শুধু এই আসরের বাস্তবতায় প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই বেশি।
মাশরাফি বিন মুর্তজা স্বীকার করলেন, হতাশার যথেষ্ট কারণ আছে। তবে একবারেই ব্যর্থ অভিযান বলতে চান না অধিনায়ক।
তবে সাকিবের অভাবনীয় পারফরম্যান্সের পর দল সেমি-ফাইনালে না ওঠা হতাশার, সেটি মানছেন অধিনায়ক।
“খারাপ লাগছে সাকিবের জন্য। এরকম পারফরম্যান্সের পর তার দল সেমি-ফাইনাল খেলবে, এটিই প্রত্যাশিত। অন্যরা যারা রান করেছে বা উইকেট নিয়েছে, হয়তো সময়মতো করতে পারেনি বা প্রয়োজনের সময় হয়নি। এটা হতাশার।”
এই হতাশার আঁধারকে পাশে রেখেও নতুন দিনের আলো দেখতে পাচ্ছেন অধিনায়ক। পরের বিশ্বকাপে তিনি থাকবেন না, তবে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন দলের।
“যে উইকেটে আমরা পরের বিশ্বকাপ খেলব (ভারতে), আমি অবশ্যই আশাবাদী। এই দলের যারা থাকবে, নতুন ক্রিকেটার আসবে, এই দল আরও সামনে এগোবে নিশ্চিতভাবেই। এটিই বাস্তবতা। আক্ষেপ করার বেশি কিছু নেই।”
আক্ষেপের রেশ তবু হয়তো কিছুদিন থাকবেই। এরপর অধিনায়ক যেমন বলেছেন, নতুন স্বপ্নে এগিয়ে চলা!