গ্রাউন্ড ফিল্ডিং কেন ধারাবাহিক নয়?

কখনও সোজা বল হাত ফসকে যাচ্ছে, কখনও বেরিয়ে যাচ্ছে দুই পায়ের পায়ের ফাঁক গলে। কখনও বলের কাছে ছুটতে দেরি, কখনও থ্রো করতে। ডাইভের টাইমিং ঠিক হচ্ছে, কখনও দেখা যাচ্ছে না ডাইভের তাগিদও। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রাউন্ড ফিল্ডিং জাগিয়ে তুলছে প্রশ্নের অবকাশ।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিনটিংহ্যাম থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 June 2019, 02:46 PM
Updated : 22 June 2019, 07:35 AM

ক্রিকেটের নিয়মে ব্যাটিং বা বোলিংয়ে বাজে দিন আসে-যায়। ক্যাচ মিসও খেলার অংশ। বিশ্বের সেরা ফিল্ডারের হাত থেকেও দু-একদিন ফসকাতে পারে সহজ ক্যাচ। কিন্তু ক্রিকেটের বাস্তবতায়ই বলা হয়, গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে বাজে দিন আসার কোনো কারণ নেই।

দু-একটি মিসফিল্ড হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দলের অনেকেই ইনিংস জুড়ে বারবার মিসফিল্ড করলে, সেই ধারা এক ম্যাচ থেকে আরেক ম্যাচে বয়ে নিলে, তা ফিল্ডিংয়ের সামগ্রিক মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বিশ্বকাপে এবার বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়ে এই চিত্রই দেখা গেছে নিয়মিত। দলীয় পারফরম্যান্সে ফিল্ডিংয়ের প্রভাব স্পষ্ট ম্যাচের ফলেও। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো ম্যাচে গ্রাউন্ড ফিল্ডিং ছিল বেশ ভালো। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তীব্র লড়াই করে হেরে যাওয়া ম্যাচে ফিল্ডিং ছিল ভালো-মন্দ মেশানো। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যাওয়া দুই ম্যাচের গ্রাউন্ড ফিল্ডিং ছিল যাচ্ছেতাই।

ব্যাটিং উইকেটে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে, বাংলাদেশের মতো সীমিত বোলিং সামর্থ্যের দলের জন্য ফিল্ডিংয়ে জ্বলে ওঠা, বোলারদের সহায়তা করা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ; হয়েছে উল্টো। ফিল্ডাররা অনেক সময় আলগা করে দিয়েছে চাপ।

অধিনায়কের ভাবনা

দলের নির্ভরয়োগ্য ফিল্ডারদের একজন মাহমুদউল্লাহ ম্যাচ খেলছেন থ্রোয়িং আর্মে চোট নিয়ে। ছোটখাটো চোট সমস্যা আছে আরও কয়েকজনের। এ সবের প্রভাব কিছু পড়তে পারে ফিল্ডিংয়ে। দু-তিন জন আছেন, তাদের ফিল্ডিংয়ের মান এমনিতেও খুব সুবিধের নয়। মাঠে তাদেরকে লুকিয়ে রাখার জায়গা খুঁজতে হয়। সব মিলিয়ে দলের ফিল্ডিং যে ভালো হচ্ছে না, সেটি মানছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। অধিনায়কের ধারণা, মূল কারণটি হতে পারে মনস্তাত্ত্বিক।

“ইনজুরি একটি বড় কারণ তো বটেই। তবে আসলে আমার কাছে মনে হয়, অনেক সময় হয়তো ছেলেরা টেন্সড থাকে, নার্ভ ধরে রাখতে পারে না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় বলটা ধরতে বা কোন প্রান্তে থ্রো করবে, এসব পারে না। ওদের ফিঞ্চ যেমন করেছে (অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ম্যাচে), আমরা হয়তো বা সেভাবে নার্ভ ধরে রাখতে পারিনি।”

বাংলাদেশের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের এত বেশি রান করার পেছনে বোলিংয়ের পাশাপাশি একটি কারণ ফিল্ডিংও, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন অধিনায়ক।

“বোলিংয়ে তো অবশ্যই ঘাটতি কিছু ছিল। পাশাপাশি ফিল্ডিংও। এসব ম্যাচে দারুণ ফিল্ডিং দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে হয়। কিছু চার বাঁচিয়ে, দুই-এক রান বাঁচিয়ে বোলারকে উজ্জীবিত করতে হয়। কিন্তু দুই ম্যাচেই আমরা কিছু চার ঠেকাতে পারিনি। এক রানের জায়গায় দুই রান হয়ে গেছে, দুইয়ের জায়গায় তিন। বোলার তাতে আরও ঝিমিয়ে পড়ে।”

ফিল্ডিং ও শরীরী ভাষা, একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে প্রবলভাবে। কখনও কখনও মিসফিল্ড থেকে শরীরী ভাষা নুয়ে পড়তে শুরু করে। শরীরী ভাষা নুয়ে পড়তে থাকলে ফিল্ডিং হয় আরও খারাপ। অধিনায়কের সেখানে বড় দায়িত্ব দলকে চাঙা রাখা, উজ্জীবিত করে প্রাণবন্ত রাখার চেষ্টা করা। মাশরাফির দাবি, সেই চেষ্টার কোনো কমতি তিনি বা টিম ম্যানেজমেন্ট রাখছে না।

“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, একটি জুটি গড়ে উঠলেই আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গতকাল দেখেন, ফিঞ্চ আউট হওয়ার পর, ওয়ার্নার ও খাওয়াজার জুটির শুরুতে ৭-৮ ওভার খুব ভালো ছিল ফিল্ডিং। ওরা সেট হওয়ার পর অনেকের মধ্যে হয়তো আলগা ভাব চলে এসেছে।”

“এসব নিয়ে মাঠের ভেতরে-বাইরে কথা হচ্ছে অনেক। সবসময়ই বলছি। টিম মিটিংয়ে বারবার বলা হচ্ছে, একটা জুটি গড়ে উঠলেই বরং ভালো ফিল্ডিং বেশি জরুরি। আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং করে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে চাপে রাখতে হবে। সেটা আমরা ধারাবাহিকভাবে পারছি না। কোনো অজুহাতের সুযোগ আসলে নেই। সামনে ভালো করতেই হবে।”

ফিল্ডিং কোচ যা বলছেন

গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের ফিল্ডিং কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন রায়ান কুক। দক্ষিণ আফ্রিকান গ্রেট গ্যারি কারস্টেনের পরামর্শে নিয়ে আসা এই দক্ষিণ আফ্রিকান ফিল্ডিং কোচের কাজে শুরু থেকেই উচ্ছ্বসিত ক্রিকেটারদের থেকে শুরু করে দল সংশ্লিষ্টদের বেশিরভাগ। নানা সময়ে তারা সেসব বলেছেন। দলের অনুশীলনে কুকের খাটুনি ও প্রচেষ্টাও চোখে পড়ে ভালোভাবেই। তার পরও কেন ধারাবাহিকতা আসছে না?

ফিল্ডিং প্রত্যাশামতো হচ্ছে না, অকপটে স্বীকার করে নিলেন কুকও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে ফিল্ডিং কোচের দাবি, মাঠের কারণেও অনেক সময় ঠিকমতো ধরা যায়নি বল।

“অবশ্যই ফিল্ডিং পারফরম্যান্সে উঠা-নামা ছিল, আমরা অধারাবাহিক এখনও পর্যন্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার আমাদের ফিল্ডিং দারুণ ছিল। তবে হ্যাঁ, বল পিক আপ বা অনুমান করে নেওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটু ভালো আমরা হতে পারতাম।”

“এমনিতে ক্যাচ নেওয়া বা রান আউটের সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমরা খারাপ করিনি মনে হয়। গ্রাউন্ড বলের ক্ষেত্রে যেটা হয়, অনেক সময় আচমকা বাজে বা অস্বস্তির বাউন্সের কারণে বল ধরতে সমস্যা হতে পারে। তবে বিশ্বাস করুন, চেষ্টার কমতি কেউ করে না।”

হয়তো চেষ্টার কমতি ক্রিকেটারদের নেই। তবে একই ভুল বারবার হতে থাকলে প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। কুক যদিও প্রক্রিয়া নিয়ে আঙুল তুলতে নারাজ। তবে উন্নতির প্রয়োজন অস্বীকার করছেন না।

“আমাদের দলে এমন ক্রিকেটার আছেন, ১৫-১৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে, ফিল্ডিং করছে। তারা জানে কাজটা কী। ব্যাটিং-বোলিংয়ের মতো অতটা ফিল্ডিং তাদের জন্য জরুরি নয়।”

“আর সবারই নিজস্ব শক্তি-দুর্বলতার জায়গা আছে। ক্যাচিং বা থ্রোয়িং কিংবা গ্রাউন্ড ফিল্ডিং, একেকজনের একেক জায়গায় উন্নতি দরকার। প্রতিদিনই উন্নতি করার তাগিদ থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে ওয়ার্ক এথিকস নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই।”

‘ওয়ার্ক এথিক’ ভালো হলো ফিল্ডিং কেন ভালো হচ্ছে না? এখানে কুক জানালেন তার অসহায়ত্ব। তিনি কেবল অনুশীলনে চেষ্টাই করতে পারেন, মাঠে তো কাজটা ক্রিকেটারদেরই!

“কেন ভালো হয়নি ফিল্ডিং, বাইরে থেকে পুরোপুরি বোঝা কঠিন। ঠিক ওই সময়টায় ক্রিকেটারদের ভাবনায় কী চলছিল বা মানসিকতা কেমন ছিল, বলা কঠিন। তবে একটা ব্যাপার আমরা চেষ্টা করছি, প্রচেষ্টায় যেন ঘাটতি না থাকে।”

“ক্রিকেটে এখন শুধু বল এলেই ফিল্ডিং গুরুত্বপূর্ণ নয়। বল কাছে না এলেও মাঠে নড়াচড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ছুটোছুটি করা, স্টাম্পের পেছনে দাঁড়ানো, এসব করলে ভালোভাবে সম্পৃক্ত থাকা যায়। এসব পুরোপুরি অভ্যস্ত হলে হয়তো আরও উন্নতি হবে।”

অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ডের মতো যারা বরাবরই দারুণ ফিল্ডিং দল, সহজাত শারীরিক সামর্থ্যেও তারা বাংলাদেশের থেকে অনেকটা এগিয়ে। তবে শারীরিক সেই সীমাবদ্ধতা জয় করা ও অন্যদের সঙ্গে ব্যবধান কমানোর পথও দেখিয়ে দিলেন কুক।

“শারীরিক সামর্থ্য একটি বড় ব্যাপার বটে। আমি বিগ ব্যাশে কাজ করেছি, দেখেছি দলের প্রতিটি ক্রিকেটার সীমানা থেকে গুলির বেগে ফ্ল্যাট থ্রো করতে পারে। ওরা প্রকৃতিগতভাবেই অ্যাথলেট। ওদের সঙ্গে শক্তির জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কঠিন।”

“আমাদের ছেলেরা যেটা করতে পারে, থ্রো যেন আরও অ্যাকুরেট হয়। রুবেল যেমন কালকে দেখিয়েছে (ম্যাক্সওয়েলকে রান আউট)। ওদের চেয়ে জোরে দৌড়ানো বা জোরে থ্রো করা, এসব ক্ষেত্রে শারীরিক গঠনের ব্যাপার থাকে। কিন্তু থ্রো নিখুঁত করা বা ক্যাচ সবগুলো নেওয়া, মাঠে চটপটে থাকা, এসবে আমরা ওদেরকে ছাড়াতে পারি।”

ছাড়াতে হলে এই বিশ্বকাপে সুযোগ কমে আসছে ক্রমেই। প্রাথমিক পর্বে বাকি আর কেবল তিনটি ম্যাচ, দেখানোর সময় এখনই!