১৯৯২: কোণঠাসা পাকিস্তানের চমক

রঙিন পোশাক, সাদা বল। কালো সাইটস্ক্রিন, কৃত্রিম আলো। টিভি সম্প্রচারে নতুনত্ব, দর্শকে ঠাসা স্টেডিয়াম। অনেক দিক থেকেই ১৯৯২ বিশ্বকাপ ছিল চমক জাগানিয়া। তবে আলো ঝলমলে আসরের সবচেয়ে বড় চমকের নাম ছিল পাকিস্তান। খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেভাবে শিরোপা জিতেছিল ইমরান খানের দল, তা চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছে ক্রিকেটীয় রূপকথায়।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2019, 09:31 AM
Updated : 24 May 2019, 09:31 AM

বিদায়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান। অধিনায়ক ইমরান খান সেদিন টস করতে নামলেন জার্সির বদলে সাদা টি শার্ট গায়ে, যেখানে আঁকা বাঘের ছবি। ধারাভাষ্যকারের প্রশ্নে ইমরান বললেন, “আমি দলকে বলেছি কোণঠাসা বাঘের মতো লড়াই করতে। নিশ্চয়ই জানেন, কোণঠাসা বাঘ কতটা বিপজ্জনক!”

ইমরানের কথাকে সত্যি প্রমাণ করেছিল দল। সেই ম্যাচ থেকেই অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান।

পাকিস্তানের শিরোপা জয় ছিল উত্তেজনাপূর্ণ নাটকের শেষ অঙ্ক। তবে নাটকীয়তার অনেক রসদ ছিল শুরু থেকেই।

৬০ ওভার থেকে ওয়ানডে ৫০ ওভারে নেমে এসেছিল আগের বিশ্বকাপেই। ৩০ গজের বৃত্তের সঙ্গেও পরিচয় হয়ে গিয়েছিল সেবার। অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ হয়ে যাওয়া পঞ্চম আসরে দেখা মেলে অনেক নতুনের, অনেক প্রথমের।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বদল ছিল, প্রথম ১৫ ওভারে ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে ২ জনের বেশি ফিল্ডার রাখতে না পারা। ক্রিকেটের চিরায়ত ঘরানা বদলে যাওয়ার মূলে ছিল সেই নিয়ম। এই নিয়মের সুবিধা নিতেই জন্ম হয় পিঞ্চ হিটিংয়ের। ঝড়ো ব্যাটিংয়ের যে ধারা পরবর্তীতে নানাভাবে বিবর্তিত হয়ে এখন রূপ নিয়েছে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের স্বাভাবিকতায়।

তাসমান পারের দুই দেশের ১৮টি ভেন্যুতে সেবার হয়েছিল ৩৯ ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার ১১ ভেন্যুতে ২৫ ম্যাচ, নিউ জিল্যান্ডের ৭ ভেন্যুতে ১৪টি। দক্ষিণ গোলার্ধে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপেই প্রথমবার রঙিন পোশাকে খেলে দলগুলো। সামঞ্জস্য রাখতে খেলা হয় সাদা বলে, কালো সাইটস্ক্রিনে। প্রথমবারের মতো কিছু ম্যাচ হয় দিন-রাতের। দুই সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে ছিলেন ম্যাচ রেফারি।

শুরুতে আগের চার আসরের মতোই আট দলকে নিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের ভাবনা ছিল। বর্ণবাদ প্রথার অবসানের পর ২১ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরায় পরিবর্তন আনতে হয় ফরম্যাটে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেয় ৯ দল। লিগের মতো একে অন্যের বিপক্ষে খেলে দেশগুলো। সেরা চার দল জায়গা করে নেয় সেমি-ফাইনালে। এই ফরম্যাটেই হবে ২০১৯ বিশ্বকাপ।

টানা তৃতীয়বারের মতো বাছাই পর্ব পেরিয়ে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় জিম্বাবুয়ে। এই আসরের পরপরই পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা পেয়ে যায় তারা।

জিম্বাবুয়ের কাছে বাছাই পর্বের সেমি-ফাইনালে হেরে ভেঙে যায় বাংলাদেশের আরেকটি বিশ্বকাপ স্বপ্ন। ইংল্যান্ডের বাইরে প্রথমবারের মতো হয় বাছাই পর্ব। ফাইনালে স্বাগতিক নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে দেয় জিম্বাবুয়ে।

ব্রায়ান লারা, ইনজামাম-উল-হকের মতো কিংবদন্তিদের আগমণী বার্তা ছিল এই বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের গল্পগাঁথায় স্থায়ী আসন পেয়ে গেছে কিছু পারফরম্যান্স। ইনজামামকে জন্টি রোডসের ডাইভ দিয়ে করা রান আউট কিংবা ওয়াসিম আকরামের দুর্দান্ত ইনসুইংয়ে ইংল্যান্ডের ক্রিস লুইসের বোল্ড হয়ে যাওয়া আজও হয়ে আছে ওয়ানডে ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন।

১৯৯২ বিশ্বকাপে পরিষ্কার ফেভারিট ছিল অস্ট্রেলিয়া। আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন দল ততদিনে আরও পরিণত। নিজ আঙিনায় খেলা, ক্রিকেটাররাও ছিলেন ছন্দে। কিন্তু বদলে যাওয়া নিয়মের সঙ্গে হয়তো মানিয়ে নিতে পারেনি শিরোপাধারীরা।

ঠিক উল্টো কাজটা করে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেয় নিউ জিল্যান্ড। ব্যাট হাতে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মার্টিন ক্রো। ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেন উদ্ভাবনী অধিনায়কত্বে। জেতেন এই আসর দিয়ে শুরু হওয়া বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।

প্রথম ১৫ ওভারের ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার সুবিধা নিতে মারকুটে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান মার্ক গ্রেটব্যাচকে ওপেনিংয়ে নামিয়ে দেন ক্রো। নতুন ভূমিকায় দারুণ সফল হন গ্রেটব্যাচ।

ক্রোর আরেকটি বড় চমক ছিল অফ স্পিনার দীপক প্যাটেলকে দিয়ে বোলিংয়ের সূচনা করা। এখন স্পিনে শুরু নিয়মিত হলেও সেই সময়ে এটি ছিল প্রায় অভাবনীয়। বিস্মিত প্রতিপক্ষরা ভড়কে যায় এই পদক্ষেপে।

ব্যাটিং ও বোলিংয়ে অমন বিপ্লবী ভাবনা আর মিডল অর্ডারে ক্রোর অসাধারণ ধারাবাহিকতায় নিউ জিল্যান্ড হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। টানা সাত ম্যাচ জিতে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে সবার ওপরে থেকে সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করে তারা।

আট ম্যাচের মধ্যে পাঁচ জয়, দুই হার এবং এক পরিত্যক্ত ম্যাচ থেকে ১১ পয়েন্ট নিয়ে ইংল্যান্ডের অবস্থান ছিল টেবিলের দুইয়ে। ১০ পয়েন্ট নিয়ে সেমি-ফাইনালের তৃতীয় দল দক্ষিণ আফ্রিকা। দুই দশকের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরা দলটি নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপেই উপহার দেয় বিস্ময়। দুর্দান্ত ফিল্ডিং, দারুণ পেস বোলিং আর ব্যাটিং গভীরতা- সর্বোপরি ক্রিকেট বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও দারুণ পেশাদারীত্বের পরিচয় দেয় প্রোটিয়ারা।

সেরা চমক ছিল পাকিস্তানের সেমি-ফাইনালে ওঠা। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১০ উইকেটে বিধ্বস্ত হয় তারা। প্রথম পাঁচ ম্যাচে একমাত্র জয় ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। আর একটি পয়েন্ট ঝুলিতে ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ থেকে। ৭৪ রানে অলআউট হলেও বৃষ্টি বাঁচিয়ে দেয় পাকিস্তানকে। পরিত্যক্ত ম্যাচ থেকে পাওয়া ওই ১ পয়েন্ট পরে হয়ে ওঠে মহামূল্য।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ‘কোণঠাসা বাঘ’ হিসেবে খেলতে নামা ম্যাচে জয় দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আখ্যানের শুরু। এরপর শ্রীলঙ্কা ও শেষ ম্যাচে তখনও পর্যন্ত অপরাজেয় নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে দেয় ইমরানের দল।

তারপরও সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত ছিল না তাদের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিতলেই সেমিতে উঠত ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু আগেই বিদায় নেওয়া অস্ট্রেলিয়া ৫৭ রানে হারিয়ে দেয় ক্যারিবিয়ানদের। অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমান ৪টি করে ম্যাচ জিতলেও পরিত্যক্ত ম্যাচের ১ পয়েন্টে মোট ৯ পয়েন্ট নিয়ে শেষ দল হিসেবে শেষ চারে জায়গা পায় পাকিস্তান।

সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ফলের দেখা মেলে প্রাথমিক পর্বের শেষ দিনে। মাত্র ১৩৪ রান করেও ইংল্যান্ডকে ৯ রানে হারিয়ে দেয় জিম্বাবুয়ে। এই ম্যাচের ফল পরবর্তীতে ভূমিকা রেখেছিল তাদের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে।

বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে লক্ষ্য নির্ধারণের নিয়মে পরিবর্তন এসেছিল; সেমি-ফাইনালে যে নিয়মের বলি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

আগে ব্যাটিং করে ইংলিশরা ৬ উইকেটে তোলে ২৫২ রান। জবাবে জয়ের পথেই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এক সময় তাদের প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রান, হাতে চার উইকেট। ক্রিজে ছিলেন ব্রায়ান ম্যাকমিলানের মতো আগ্রাসী ব্যাটসম্যান। সেই সময় কেঁদে ওঠে সিডনির আকাশ। মাত্র ১০ মিনিটের বর্ষণে কাঁদিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকানদের। নতুন নিয়মের ফাঁদে ১৩ বলে ২২ রানের লক্ষ্যটা যে পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় ১ বলে ২১ রানে!  হৃদয় ভাঙা হারে সেমি-ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

আরেক সেমিতে পাকিস্তানের নিয়তি এঁকে দেয় তরুণ ইনজামামের ব্যাট। সাত উইকেটে ২৬২ রান করে এক রকম নিশ্চিন্ত ছিল নিউ জিল্যান্ড। ১৪০ রানের মধ্যে প্রতিপক্ষের চার উইকেট তুলে জয় দেখছিল স্বাগতিকরা। তবে শেষ দিকে ইনজামামের ৩৭ বলে ৬০ রানের সাইক্লোন-ইনিংস অবিশ্বাস্যভাবে চার উইকেটে জিতিয়ে দেয় পাকিস্তানকে। বিশ্বকাপে চতুর্থ সেমি-ফাইনালে এসে প্রথমবারের মতো ফাইনালের টিকেট পায় তারা।

ইংল্যান্ডের সেটি তৃতীয় ফাইনাল। আত্মবিশ্বাসে টগবগিয়ে ফোটার কারণ ছিল। গ্রুপ পর্বে এই পাকিস্তানকেই তো মাত্র ৭৪ রানে অলআউট করে দিয়েছিল তারা! প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের প্রত্যাশা তাই খুব স্বাভাবিকই ছিল ইংলিশদের।

ফাইনালে পাকিস্তানের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে ২৫ রানের মধ্যেই তুলে নেন ডেরেক প্রিঙ্গেল। দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ইমরান খান ও জাভেদ মিয়াঁদাদ এরপর পাকিস্তানের ইনিংসকে দেন স্থিতি। রানের পেছনে না ছুটে উইকেট আগলে রাখেন শুরুতে। ইমরানের ৭২ ও মিয়াঁদাদের ৫৮ রানের পর শেষ দিকে ইনজামাম (৩৫ বলে ৪২) ও ওয়াসিম আকরামের (১৮ বলে ৩৩) ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ছয় উইকেটে ২৪৯ রানে ইনিংস শেষ করে পাকিস্তান।

জবাব দিতে নেমে ইংল্যান্ডের শুরুটা ছিল এলোমেলো। স্কোরবোর্ডে ৬৯ রান তুলতেই চার উইকেট হারিয়ে বসে তারা। অ্যালান ল্যাম্ব ও নিল ফেয়ারব্রাদারের ৭১ রানের জুটি তাদের ফেরায় কক্ষপথে। ম্যাচ মুঠো ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে আকরামকে তড়িঘড়ি করে দ্বিতীয় স্পেলে ফেরান ইমরান। সেটি কাজ করে জাদুর মতো। ল্যাম্ব ও লুইসকে জাদুকরী দুটি ইনসুইংয়ে বোল্ড করেন বাঁহাতি পেসার। ব্যস, ঘুরে যায় ম্যাচের মোড়। কিছুক্ষণ পর আকিব জাভেদ ফেয়ারব্রাদারকে আউট করলে শেষ হয়ে যায় ইংল্যান্ডের আশা। তাদের ২২৭ রানে অলআউট করে পাকিস্তান ফাইনাল জিতে নেয় ২২ রানে।

সবচেয়ে বেশি রান:

ব্যাটসম্যান/দেশ

ম্যাচ

রান

সেরা

গড়

১০০/৫০

মার্টিন ক্রো/নিউ জিল্যান্ড

৪৫৬

১০০*

১১৪.০০

১/৪

জাভেদ মিয়াদাঁদ/পাকিস্তান

৪৩৭

৮৯

৬২.৪২

০/৫

পিটার কারস্টেন/দক্ষিণ আফ্রিকা

৪১০

৯০

৬৮.৩৩

০/৪

ডেভিড বুন/অস্ট্রেলিয়া

৩৬৮

১০০

৫২.৫৭

২/০

রমিজ রাজা/পাকিস্তান

৩৪৯

১১৯*

৫৮.১৬

২/০

সবচেয়ে বেশি উইকেট:

বোলার/দেশ

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

ওয়াসিম আকরাম/পাকিস্তান

১০

১৮

৪/৩২

১৮.৭৭

৩.৭৬

ইয়্ন বোথাম/ইংল্যান্ড

১০

১৬

৪/৩১

১৯.১২

৩.৪৩

মুশতাক আহমেদ/পাকিস্তান

১৬

৩/৪১

১৯.৪৩

৩.৯৮

ক্রিস হ্যারিস/নিউ জিল্যান্ড

১৬

৩/১৫

২১.৩৭

৪.৭৩

এডো ব্র্যান্ডেজ/জিম্বাবুয়ে

১৪

৪/২১

২৫.৩৫

৫.০৫