স্মৃতিকাতর সৌরভ আপ্লুত বাংলাদেশের ভালোবাসায়

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত মেয়র কাপের দ্বিতীয় মৌসুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলার সেই দিনগুলিতে ফিরে গেলেন সৌরভ গাঙ্গুলি।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2023, 03:17 PM
Updated : 23 Feb 2023, 03:17 PM

লিফটের সামনে অপেক্ষায় গোটা পঞ্চাশেক টিভি ক্যামেরা। মোবাইল ফোন তো অগুনতি। সবার অধীর অপেক্ষা, কখন খুলবে লিফটের দরজা। প্রতীক্ষা যেন ফুরোয় না। লিফটের দরজা খুলতেই সবার অধীর আগ্রহের পিপাসা মিটিয়ে বেরিয়ে এলেন সৌরভ গাঙ্গুলি।  

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়েছেন তিনি প্রায় দেড় দশক আগে। স্বীকৃত পর্যায়ে শেষবার খেলারও হয়ে গেছে ১০ বছরের বেশি। তবু যেন এতটুকু কমেনি সৌরভের আবেদন। নিজ দেশ ভারত তো বটেই, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশেও আগ্রহের কেন্দ্রে তিনি। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে এসে সবার ভালোবাসায় আপ্লুত ভারতের সাবেক অধিনায়ক ফিরে গেলেন নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের দিনগুলিতে, যেখানে মিশে আছে এদেশের তার বিচরণের অধ্যায়ও। 

ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন, ভারতীয় ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার নায়ক, প্রবল প্রতাপশালী ভারতীয় বোর্ডের সদ্য সাবেক প্রধান তিনি। তবে বাংলাদেশে বরাবরই তাকে নিয়ে বাড়তি আবেগ তিনি বাঙালি বলেই। লম্বা বিরতির পর তিনি বাংলাদেশে এলেন বৃহস্পতিবার বিকেলে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের আমন্ত্রণে 'ডিএনসিসি মেয়র কাপ-২০২৩' এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।  

ফ্লাইট বিলম্বের কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। সেখানে মধ্যমণি সৌরভই। পুরো আয়োজনে সবটুকু আলো তার ওপরই।  মেয়র আতিকসহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান, বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন, সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান, খালেদ মাসুদরা। সাবেক ফুটবলার কায়সার হামিদও ছিলেন শুরু থেকে।  

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে লাইট শো ও ফ্ল্যাশমব করা হয়। এরপর দেখানো হয় সৌরভের ক্যারিয়ার বিশেষ ডকুমেন্টারি। পাশাপাশি বাজানো হয় তাকে নিয়ে লেখা বিশেষ গান। 

টুর্নামেন্টের শুভেচ্ছাদূত হয়ে আসা সৌরভের হাতে ঢাকা শহরের প্রতীকী চাবি তুলে দেন মেয়র আতিক। 

অতিথিদের বক্তব্যের পর মেয়র কাপের তিন খেলা ক্রিকেট, ফুটবল ও ভলিবলের ট্রফি উন্মোচন করেন সৌরভ। এসময় তার নাম ও জার্সি নম্বর লেখা জার্সি দিয়ে টুর্নামেন্টের জার্সিও উন্মোচন করা হয়।  

সৌরভের বক্তব্যে মিশে থাকল এই দেশের প্রতি তার আবেগ। এদেশের মানুষের ভালোবাসার উষ্ণ পরশের কথাও বললেন ৫০ বছর বয়সী সাবেক ক্রিকেটার। 

“আমি বহুদিন ধরে যাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছি আকরাম (খান), আতহার (আলি খান), (খালেদ মাসুদ) পাইলট আছে এখানে। আমি অনেক দিন পর এলাম ঢাকায়। সবশেষ এসেছিলাম (২০১৪) টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়, যেবার শ্রীলঙ্কার কাছে ফাইনালে হারে ভারত। তখন সবশেষ ঢাকায় আসি।”  

“ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ায় এরপর আর সময় হয়ে ওঠেনি এখানে আসার। তবে একটা কথা আমি বলি, যতবারই আমি এখানে আসি, এত মানুষের ভালোবাসা পাই যে বুঝতে পারি না এটা ভারত না বাংলাদেশ। আমাকে এত ভালোবাসা, এত নিজের মনে করার জন্য আমার তরফ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।” 

তিন দশকেরও বেশি সময় আগে প্রথমবার বাংলাদেশে আসার স্মৃতিও রোমন্থন করলেন তিনি। 

“আমার যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশে আমি প্রথম আসি ১৯৮৯ সালে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে এশিয়া কাপ খেলতে এসেছিলাম। সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। এখানে প্রচুর মানুষ আমার বন্ধু। ( বিসিবি পরিচালক ইফতেখার রহমান) মিঠুর কথা শুনলেন। সেই দিন থেকে আমার বন্ধু। দশ বছর আমি বাংলাদেশে আসিনি। তবে তার সঙ্গে, তার পরিবারের সঙ্গে ও বাকি বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই আমার দেখা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।” 

প্রাসঙ্গিকভাবেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের ঐতিহাসিক একটি দিনে ফিরে যান তিনি স্মৃতির সরণি বেয়ে।   

“আমার প্রথম টেস্ট অধিনায়কত্ব বাংলাদেশের মাটিতে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গে আমার নাম সবসময় জড়িয়ে থাকবে। কারণ ওটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ, ২০০১ সালে (আসলে ২০০০)। আর আমার প্রথম টেস্ট, ভারতের অধিনায়ক হিসেবে।” 

“আমার এখনও মনে আছে, তখনও নতুন স্টেডিয়াম হয়নি। পুরনো স্টেডিয়াম, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা হয়েছিল। বাংলাদেশ মনে হয় প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েছিল। তারপর যখন ড্রেসিং রুমে ঢুকি আমি, আমার মনে হলো, 'এ কী! আমি অধিনায়ক হিসেবে আমার প্রথম ম্যাচ হেরে যাব!' তারপর আমরা ফিরে এসে টেস্ট ম্যাচটা জিতি।” 

ওই অভিষেক টেস্টেরও দুই বছর আগে বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ জিতে গিয়েছিল ভারত। ত্রিদেশীয় সিরিজের তিন ম্যাচের ফাইনালের শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে গাঙ্গুলির সেঞ্চুরিতে (১৩৮ বলে ১২৪) পাকিস্তানকে ৩ উইকেটে হারায় তারা।  

স্মরণীয় সেই ম্যাচের প্রসঙ্গে উঠে এলো শেষ সময়ে আলো আঁধারির সেই নাটকীয়তাও।

“আমার জীবনের বহু মূল্যবান মুহূর্তের সাক্ষী বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের মানুষ। এখনও মনে আছে, ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের ফাইনালে আমরা ৩১৫ রান তাড়া করে জিতি। তখনকার দিনে ৩১৫ রান অনেক বড় ছিল। কিন্তু আমার মনে আছে, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এত সুন্দর আলো বা ফ্লাডলাইট ছিল না তখন। ফুটবলের বাতির আলোয় খেলা হয়েছে শেষ পর্যন্ত আর আমরা সেই ম্যাচটা সেখানে জিতি।” 

বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের প্রসঙ্গে সৌরভের কাছে উপস্থাপক প্রশ্ন রাখেন, ওই ম্যাচে টস জিতে তিনি বাংলাদেশকে আগে ব্যাটিং দিতেন কি না। সৌরভ সেই সময়ের ভাবনা জানালেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের উইকেটের প্রশংসা করে। 

“না… (বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে) পাঠাতাম না। আমি টসে হেরে গিয়েছিলাম, ওরা ব্যাট করেছিল। ঠিকই করেছিল। কারণ এত ভালো উইকেট! তখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের উইকেট এত ভালো ছিল... আমি তো ওপেন করতাম। যখন আমি আর শচীন (টেন্ডুলকার) ব্যাটিং করতে যেতাম, উইকেটে শাইন হতো। দেখে বোঝা যেত, কত ভালো উইকেট। আর ভালো উইকেটে কখনও প্রতিপক্ষকে ব্যাটিং করতে দিতে নেই (হাসি)।” 

২০১৯ সালে বাংলাদেশের আরও একটি প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে যায় সৌরভের নাম। ওই বছর বাংলাদেশকে গোলাপি বলের দিবারাত্রির টেস্টে আমন্ত্রণ জানায় ভারত। দুই দলের জন্যই সেটি ছিল প্রথম দিনরাতের ম্যাচ।  

“আমার এখনও মনে আছে যখন প্রথম পিংক টেস্ট হয়... এটাও  কাকতালীয়। ভারতের বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেটিই ছিল আমার প্রথম পিংক টেস্ট, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। আপনাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) তখন আমার আমন্ত্রণে ভারতে গিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে প্রচুর মধুর সময় কেটেছে আমার।” 

মেয়র কাপের আয়োজকদেরও ধন্যবাদ জানান তিনি দারুণ আয়োজনের জন্য। 

“বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের মানুষ এই যে মাদকমুক্ত দেশ গড়ার চেষ্টা করছেন, এটা সত্যিই প্রয়োজনীয়। সারা পৃথিবীতে হয়। আমি বিভিন্ন দেশে এমন ক্যাম্পেইন দেখেছি। কারণ মাদক কমবয়সী যুব সমাজের জন্য একটা আতঙ্কের কারণ। আমি মাননীয় মেয়রকে ধন্যবাদ জানাই, উনি বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে যুবসমাজকে ব্যস্ত রেখেছেন। আমি মনে করি, মাদকমুক্ত দেশ হওয়ার জন্য খেলাধুলাই একমাত্র সমাধান।” 

“আমি সবার কাছে অনুরোধ করব, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে যে, মাদক কোনো সমাধান নয়। জীবনের জন্য একমাত্র সমাধান হলো কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। তাই খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকো, গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত থাকো, পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত থাকো। পড়াশোনা, ডিগ্রি তোমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।”  

বক্তব্যের শেষ দিকে বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় নিজের ভালো লাগার আরও একবার জানান ‘প্রিন্স অব কলকাতা’ বলে খ্যাত সাবেক এই ক্রিকেটার। 

“সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা, অনেক ভালোবাসি। তোমরা এরকমই থাকবে, তোমরা ভালো থাকো। আবার বলি, যতবার আমি বাংলাদেশে আসি, আমার অসাধারণ লাগে। এত মানুষের ভালোবাসা... ভালোবাসা মানে সত্যিকারের ভালোবাসা। এসব দেখে আমি সত্যিই আপ্লুত হই। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন।”