ভালো শুরুর পরও মন্থর এক ইনিংস খেললেন রাজশাহী অধিনায়ক এনামুল হক, দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে দলকে জেতালেন বরিশাল অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
Published : 06 Jan 2025, 10:19 PM
দুই দলের অধিনায়কের ব্যাটিংই ফুটিয়ে তুলছে গোটা ম্যাচকে। বিস্ময়কর এক ইনিংস খেললেন এনামুল হক। প্রথম ১১ বলে পাঁচ বাউন্ডারিতে তার রান ছিল ২১। পরের ২৪ বলে তার ব্যাটে বাউন্ডারি নেই একটিও। শেষের আগের ওভারে যখন রাজশাহী অধিনায়ক আউট হলেন, ৩৫ বল খেলেও তার রান তখন মোটে ৩৯! ব্যাটিং স্বর্গে তার অমন ইনিংসের পর দলও পারল না বড় সংগ্রহ গড়তে। বরিশালের রান তাড়া অনায়াস হয়ে উঠল অধিনায়ক তামিম ইকবালের দ্যুতিময় ব্যাটিংয়ে।
আগের ম্যাচে দারুণ কিছু শট খেলে শুরুটা ভালো করলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি তামিম। এবার দলকে ভালো শুরু এনে দিলেন, মাঝেও টেনে নিলেন এবং শেষ পর্যন্ত দলকে জিতিয়ে অপরাজিত থেকে ফিরলেন বরিশাল অধিনায়ক। তার নামের পাশে তখন জ্বলজ্বল করছে ১১ চার ও ৩ ছক্কায় ৪৮ বলে ৮৬।
যে দলকে হারিয়ে আসর শুরু করেছিল ফরচুন বরিশাল, সেই দুর্বার রাজশাহীকে আবার হারাল তারা। গত আসরের চ্যাম্পিয়নরা সোমবার সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে জিতল ৭ উইকেটে।
এনামুলের অমন ইনিংসের পর শেষ দিকে রায়ান বার্লের মন্থর ইনিংসে ২০ ওভারে স্রেফ ৪ উইকেট হারিয়েও রাজশাহী রান তোলে ১৬৮। রান তাড়ায় তামিমের ছক্কায় যখন ম্যাচ শেষ করে বরিশাল, তখনও বল বাকি ১৫টি।
ব্যর্থ প্রিতম
আগের ম্যাচে চোট পাওয়া মুশফিকুর রহিম এ দিন কিপিং করতে পারেননি। কিপার প্রিতম কুমারকে তাই একাদশে জায়গা দেয় বরিশাল। বাইরে চলে যেতে হয় জাতীয় দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তকে।
পরে বরিশালের রান তাড়ায় তামিমের সঙ্গে ইনিংস শুরুও করেন প্রিতম। কিন্তু সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি ২৩ বছর বয়সী ক্রিকেটার। মোহর শেখকে ক্রিজ ছেড়ে খেলার চেষ্টায় বোল্ড হন ৯ বলে ৩ রান করে।
তামিম-মেয়ার্সের স্ট্রোকের দ্যুতি
দ্বিতীয় ওভারে তাসকিন আহমেদের বলে তামিমের ছক্কার পরও প্রথম তিন ওভারে বরিশালের রান ছিল ওভারপ্রতি চার করে। প্রিতমের বিদায়ের পর বদলে যায় চিত্র। তিনে নেমে ওই ওভারেই চার মারার পর বিশাল ছক্কায় বল গ্যালারিতে পাঠান মেয়ার্স। পরের ওভারে শফিউল ইসলামকে টানা তিনটি চার মারেন তামিম, মেয়ার্স মারেন একটি।
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে মোহরকে টানা দুই বলে ছক্কা ও চার মেরে বোল্ড হয়ে যান মেয়ার্স (১০ বলে ২৪)। তাতেও কমেনি রানের স্রোত। ওভারের শেষ দুই বলে বাউন্ডারি আসে তামিমের ব্যাটে।
প্রথম তিন ওভারে ১২ রান করা বরিশাল পরের তিন ওভারে তোলে ৫০!
শফিউলের অবাক ধারাবাহিকতা
টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম ম্যাচে শফিউল ইসলাম প্রথম ওভারে রান দিয়েছিলেন ২০। পরের ম্যাচে গুনেছিলেন ২২ রান। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে তৃতীয় ম্যাচে অভিজ্ঞ পেসারের প্রথম ওভারে রান এলো ১৮। প্রতিটিই পাওয়ার প্লেতে।
পরের ওভারগুলোতেও খুব একটা পুষিয়ে দিতে পারেননি তিনি। এমন পারফরম্যান্সের পরও শফিউল কীভাবে সুযোগ পাচ্ছেন বা পাওয়ার প্লেতে বোলিং পাচ্ছেন, কৌতূহল জাগে বটে!
তামিম-মুশফিকের যুগলবন্দি
তাওহিদ হৃদয় বড় রানের দেখা পাননি এ দিনও। জিসান আলমের ফুলটসে সীমানায় ধরা পড়েন তিনি ১৪ বলে ১৩ রান করে।
তবে বরিশালকে ভুগতে দেননি তামিম। তার ব্যাটে স্ট্রোকের ফোয়ারা ছুটতেই থাকে। ক্রিজে গিয়ে তাকে আরও ভরসা জোগান মুশফিকুর রহিম। দুই বন্ধুর জুটিই শেষ করে দেয় ম্যাচ। দুজনের অবিচ্ছন্ন জুটিতে আসে ৪৫ বলে ৭৬ রান।
মুশফিক শুরুটা করেছিলেন একটু সাবধানী ব্যাটিংয়ে। তামিম তখন এমন গতিতে এগোচ্ছিলেন, তার সেঞ্চুরিও অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। পরে দারুণ কয়েকটি শটে দ্রুত রান বাড়িয়ে নেন মুশফিক। তাসকিনের বলে ডাউন দা উইকেটে তার একটি ছক্কা ছিল দেখার মতো। তিনি অপরাজিত থাকেন ২৪ বলে ৩৪ রান করে।
জিসানের শঙ্কা ও স্বস্তি
ম্যাচের প্রথম ভাগে রাজশাহী ব্যাটিংয়ে নামে টস হেরে। হ্যাটট্রিক শূন্যের শঙ্কা নিয়ে ম্যাচটি শুরু করেছিলেন জিসান আলম। রাজশাহীর প্রথম দুই ম্যাচেই তরুণ ওপেনার আউট হয়েছিলেন কোনো রান না করে। পরের ম্যাচে তাকে একাদশের বাইরে রাখে দল। এই ম্যাচে ফিরে পান জায়গা। তৃতীয় বলে শাহিন শাহ আফ্রিদিকে চার মেরে বিপিএল ক্যারিয়ারে রানের খাতা খোলেন ২০ বছর বয়সী ওপেনার।
ছক্কা ও জবাব
প্রথম তিন ওভারে রাজশাহীর রান ছিল ২০। চতুর্থ ওভারে তানভির ইসালামের স্পিন আক্রমণে আনে বরিশাল। তৃতীয় বলেই তাকে স্লগ করে ছক্কা মারেন মোহাম্মদ হারিস। পরের বলেই বাঁহাতি স্পিনার শোধ তোলেন জোরের ওপর করা ডেলিভারিতে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানকে (১৫ বরে ২২) বোল্ড করে।
জিসানের ঝলক
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে জাহান্দাদ খানকে পেয়ে বসেন জিসান। বরিশালের পাকিস্তানি পেসারকে টানা দুটি ছক্কার পর চার মারেন তিনি। পরে এনামুল হকের বাউন্ডারিতে ওভার থেকে আসে ২১ রান।
পাওয়ার প্লেতে রাজশাহী তোলে ৬০ রান।
পাওয়ার প্লে শেষেও কমেনি জিসানের ধার। আসরে প্রথম খেলতে নামা রিশাদের প্রথম ওভারেই মারেন তিনি ছক্কা-চার।
নিজের মতো কিছু শট যেমন তিনি খেলেছেন, আউটও হন চেনা ঢঙয়েই। ফাহিম আশরাফের প্রথম ওভারে স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে এলোমেলো শটে বিদায় নেন ২৭ বলে ৩৮ রান করে।
এনামুলের সঙ্গে তার জুটিতে আসে ৩৪ বলে ৫৫।
এনামুলের অদ্ভুত ইনিংস
এনামুলের শুরুটা ছিল ইতিবাচক। ১১ বলে তার রান ছিল ২১। এরপর হুট করেই মন্থর হয়ে যায় তার গতি। চারে নামা ইয়াসির আলি চৌধুরিও শুরু করেন ধীরগতিতে। কমে আসে দলের রানের গতিও। তিন ওভারে রান আসে ১০। ইয়াসিরের রান তখন ১১ বলে ৬। এর মধ্যে ৪ রানে জীবন পান জাহান্দাদের হাতে।
পরে হাত খোলেন ইয়াসির। জাহান্দাদের ওভারে ছক্কা ও চারের পর ফাহিমকেও মারেন চার ও ছক্কা, মাঝে ছক্কায় ওড়ান রিশাদকেও।
তাকে থামাকে শাহিন শাহ আফ্রিদিকে আক্রমণে ফেরান তামিম। প্রথম বলেই ইয়াসিরকে (২৩ বলে ৩৭) এলবিডব্লিউ করে অধিনায়ককে খুশি করে দেন আফ্রিদি।
প্রথম ১১ বলেই যিনি মেরেছিলেন পাঁচটি বাউন্ডারি, সেই এনামুল পরের ২৪ বলে আর বাউন্ডারি মারতে পারেননি একটিও! ১৯তম ওভারে তিনি আউট হন ৩৫ বলে ৩৯ রান করে।
শেষেও নেই ঝড়
এনামুল তো শেষের দাবি মেটাতেই পারেননি, যার ব্যাটে তাকিয়ে ছিল দল, সেই রায়ান বার্ল ১১ বল খেলে রান করেন ১০। শেষ ওভারে কাইল মেয়ার্সকে একটি ছক্কা মেরে আকবর আলি অপরাজিত থাকেন ৯ বলে ১৫ রানে।
শেষ ৫ ওভারে রাজশাহী তোলে কেবল ৩৫ রান।
মাঝবিরতিতেই মনে হচ্ছিল, এত ছোট সীমানার মাঠে ও এমন ব্যাটিং স্বর্গে লড়িয়ে পুঁজিও গড়তে পারেনি রাজশাহী। তামিমরা পরে সেটিই প্রমাণ করে দেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দুর্বার রাজশাহী: ২০ ওভারে ১৬৮/৪ (হারিস ২২, জিসান ৩৮, এনামুল ৩৯, ইয়াসির ৩৭, বার্ল ১০*, আকবর ১৫*, মেয়ার্স ২-০-১৮-০, আফ্রিদি ৪-০-২০-২, জাহান্দাদ ৪-০-৪৭-০, তানভির ৩-০-২৭-১, রিশাদ ৩-০-২৬-০, ফাহিম ৪-০-২৭-১)।
ফরচুন বরিশাল : ১৭.৩ ওভারে ১৬৯/৩ (তামিম ৮৬*, প্রিতম ৩, মেয়ার্স ২৪, হৃদয় ১৩, মুশফিক ৩৪*; তাসকিন ৪-০-২৭-১, জিসান ৪—২৫-১, মোহর ২-০-৩২-১, শফিউল ২-০-২২-০, বার্ল ৩-০-২৬-০, মুরাদ ২.৩-০-৩২-০)।
ফল: ফরচুন বরিশাল ৭ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তামিম ইকবাল।