জিমি অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টের প্রথম দিনটিতে আগুনে বোলিংয়ে সাত উইকেট নিলেন অভিষিক্ত পেসার গাস অ্যাটকিনসন।
Published : 11 Jul 2024, 12:43 AM
৫ উইকেট পূর্ণ করে তখন সতীর্থদের অভিনন্দনে ভাসছেন গাস অ্যাটকিনসন। গ্যালারি থেকে থেকে ভেসে আসছে করতালির কলতান আর তিনি গর্বিত ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ধরেছেন বল। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ঝুলিয়ে খুব কাছ থেকে তাকে দেখছিলেন জিমি অ্যান্ডারসন। কে জানে, হয়তো তিনি ভাবছিলেন, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা…।’
হ্যাঁ, ইংলিশ গ্রীষ্মের প্রথম টেস্ট এবার শুরু হয়েছে বিদায়ের রাগিনীতে। কিংবদন্তির ক্যারিয়ার থামছে এখানেই। সেই বিদায়ের বিষাদেই নতুন আশার ঝিলিক হয়ে এলেন অ্যাটকিনসন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম দিনটি রাঙিয়ে তুললেন তিনি সাত উইকেটের আল্পনায়। পরে ব্যাটসম্যানদের সৌজন্যে দিনটি পুরোপুরিই নিজেদের করে নিল ইংল্যান্ড।
লর্ডস টেস্টের প্রথম দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংস শেষ কেবল ১২১ রানেই। ইংল্যান্ড দিন শেষ করেছে ৩ উইকেটে ১৮৯ রান তুলে। প্রথম দিনেই ৬৮ রানের লিড নিয়ে ম্যাচের লাগাম ইংলিশদের হাতে।
সেই কাজটা করে দিয়েছেন মূলত অ্যাটকিনসন। ৪৫ রানে তার শিকার ৭ উইকেট। ইংল্যান্ডের টেস্ট ইতিহাসে অভিষেকে দ্বিতীয় সেরা বোলিংয়ের কীর্তি এটি। ১৯৯৫ সালে এই মাঠে ও ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষেই ডমিনিক কর্কের ৪৩ রানে ৭ উইকেটের রেকর্ড অক্ষত রয়ে যায় একটুর জন্য।
লর্ডসের উইকেট এ দিন তুলনামূলক সামান্য মন্থর ছিল। সুইং ও মুভমেন্ট অবশ্য মিলেছে দিনজুড়েই। অ্যাটকিনসন তা কাজে লাগিয়েছেন। তার গতি তো তার সহজাত। ১৪৫ কিলোমিটার স্পর্শ করেছেন তিনি নিয়মিতই। সব মিলিয়েই ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ২৬ বছর বয়সী পেসার।
যদিও এই ম্যাচে অনেক আবেগ আর আয়োজন অ্যান্ডারসনকে ঘিরে। টেস্ট ইতিহাসের সফলতম পেসারের শেষ টেস্ট এটি। তার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানরা ছিলেন গ্যালারিতে। ম্যাচ শুরুর ৫ মিনিট আগে বেল বাজানোর সম্মান দেওয়া হলো এ দিন তার দুই মেয়ে লোলা ও রুবিকে। জাতীয় সঙ্গীতের সময় তিনি মাঠে নামতেই গ্যালারির সব দর্শক তাকে অভিবাদন জানান দাঁড়িয়ে তুমুল তালি দিয়ে।
টসেই পূরণ হয় দর্শকদের আশা। মেঘলা আকাশের নিচে টস জিতে বোলিং নিতে একটুও ভাবতে হয়নি ইংলিশ অধিনায়ক বেন স্টোকসকে। একটু পরই লর্ডসের সবুজ আঙিনায় বল হাতে ছুটতে শুরু করেন অ্যান্ডারসন। ১৮৮ টেস্ট খেলা পেসারের শেষের শুরু!
শুধু অ্যাটকিনসন নন, দুই দল মিলিয়ে এ দিন অভিষিক্ত ক্রিকেটার ছিলেন আরও দুজন। তাদেরই একজন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনার মিকাইল লুই। ছোট্ট দ্বীপ সেন্ট কিটসের প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার। খেলার শুরুর আগে তার মাথায় টেস্ট ক্যাপ তুলে দেন তার ক্রিকেট নায়ক ও কিংবদন্তি স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। অ্যান্ডারসনের প্রথম ওভারেই দুটি বাউন্ডারিতে শুরুটাও দারুণ করেন লুই।
অ্যান্ডারসন অবশ্য দ্রুতই লাইন-লেংথ খুঁজে পান। সুইং আর মুভমেন্টও আদায় করে নিতে থাকেন। নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে শুরুটা ভালো করেন দুই ক্যারিবিয়ান ওপেনারও। অ্যান্ডারসন ও ক্রিস ওকসের প্রথম স্পেলের ১০ ওভারে ৩৪ রান তোলেন লুই ও ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট।
শুরুর ওই দুই বাউন্ডারির পর ওকসকে একটি বাউন্ডারি ও পরে ছক্কাও মারেন লুই।
এরপর দৃশ্যপটে আবির্ভাব অ্যাটকিনসনের। প্রথম বলটি করেন তিনি ১৪৩ কিলোমিটার গতিতে। পরের ডেলিভারি ছিল অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে। সেটিই স্টাম্পে টেনে আনেন ব্র্যাথওয়েট (৩৩ বলে ৬)।
নিজের তৃতীয় ওভারেই তিনি ফেরান তিনে নামা কার্ক ম্যাকেঞ্জিকে। তার বোলিংয়ে প্রথম রান আসে চতুর্থ ওভারে, সেটিও ফিল্ডারের ভুলে। প্রথম স্পেল শেষে তার বোলিং ফিগার ছিল ৫-৪-২-২!
মাত্র সাতটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অভিজ্ঞতায় টেস্ট খেলতে নামা লুই বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলছিলেন। তার ইনিংসটি থামে চোখধাঁধানো এক ক্যাচে। বেন স্টোকসের বলে স্লিপে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে এক হাতে অসাধারণ দক্ষতায় ক্যাচটি নেন হ্যারি ব্রুক। ২৩ বছর বয়সী ওপেনারের প্রথম ইনিংস থামে ২৩ রানে।
আলিক আথানেজ ও কাভেম হজ এরপর কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু দ্বিতীয় স্পেলে অ্যাটকিনসনের কোপে বিধ্বস্ত হয় ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং।
আথানেজকে ফিরিয়ে ৪৪ রানের জুটি ভাঙেন তিনি। পরের বলেই বাড়তি বাউন্সের শিকার নতুন ব্যাটসম্যান জেসন হোল্ডার।
১৪৬ কিলোমিটার ছাড়ানো পরের ডেলিভারি ঠেকিয়ে হ্যাটট্রিক হতে দেননি জশুয়া দা সিলভা। কিন্তু পরের বলেই ক্যাচ দেন তিনি উইকেটের পেছনে।
৫ উইকেট পূর্ণ করে ডানা মেলে দেন অ্যাটকিনসন।
আরেকপ্রান্তে হজকে থামিয়ে ১৫০তম টেস্ট শিকার ধরেন ওকস। এরপর ইনিংস শেষ হতেও সময় লাগেনি খুব একটা। আলজারি জোসেফ ও শামার জোসেফকে এক ওভারেই ফিরিয়ে ৭ উইকট হয়ে যায় অ্যাটকিনসনের।
গ্যালারিতে সবচেয়ে বড় গর্জন ওঠে অবশ্য ক্যারিবিয়ানদের শেষ উইকেট পড়ার পর। বোলার যে ছিলেন অ্যান্ডারসন! তার ৭০১তম টেস্ট উইকেট জেডেন সিলস।
৩ উইকেটে ৮৮ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস শেষ হয়ে যায় ১২১ রানে।
সিলস পরে বল হাতে দ্রুতই ফিরিয়ে দেন ইংলিশ ওপেনার বেন ডাকেটকে। তবে দ্বিতীয় উইকেটে দারুণ জুটি গড়েন জ্যাক ক্রলি ও অলিভার পোপ। আলোকস্বল্পতায় খেলা বন্ধ থাকার আগে-পরে মিলিয়ে ৯৪ রানের জুটি গড়েন দুজন।
১১ চারে ৫৭ রান করা পোপকে দারুণ এক ইয়র্কারে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন হোল্ডার। পরে আরও দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে ক্রলির স্টাম্প নাড়িয়ে দেন সিলস। স্বভাবসুলভ ব্যাটিংয়ে ১৪ চারে ৮৯ বলে ৭৬ রানে ফেরেন ক্রলি।
জো রুট ও হ্যারি ব্রুক পরের সময়টা কাটিয়ে দেন নির্ভরতায়। শেষ বিকেলেও দ্রুততায় রান তুলে ২৯ বলে ২৫ রানে অপরাজিত রয়ে যান ব্রুক।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ম ইনিংস: ৪১.৪ ওভারে ১২১ (ব্র্যাথওয়েট ৬, লুই ২৭, ম্যাকেঞ্জি ১, আথানেজ ২৩, হজ ২৪, হোল্ডার ০, জশুয়া ০, আলজারি জোসেফ ১৭, মোটি ১৪*, শামার জোসেফ ০, সিলস ২; অ্যান্ডারসন ১০.৪-৩-২৬-১, ওকস ১১-২-২৯-১, অ্যাটকিনসন ১২-৫-৪৫-৭, স্টোকস ৮-২-১৪-১)।
ইংল্যান্ড ১ম ইনিংস: ৪০ ওভারে ১৮৯/৩ (ক্রলি ৭৬, ডাকেট ৩, পোপ ৫৭, রুট ১৫*, ব্রুক ২৫*; আলজারি জোসেফ ১০-১-৬৬-০, সিলস ৯-১-৩১-২, শামার জোসেফ ৯-১-৪২-০, হোল্ডার ১০-০-৩৮-১, মোটি ২-০-৩-০)।