শেষ পর্যন্ত অবশ্য পড়ালেখা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে ক্রিকেটকেই ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই পেসার।
Published : 28 Mar 2024, 06:05 PM
‘মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক’, কথাটি নান্দ্রে বার্গারের জীবনের সঙ্গে মিলে যায় পুরোপুরি। লেখাপড়া করে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে জীবন গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। আর এর জন্য ঢাল বানিয়েছিলেন ক্রিকেটকে। কারণ? ক্রিকেট খেলার মাধ্যমেই যে বিনা খরচে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেই ক্রিকেটই এখন হয়ে উঠেছে তার ধ্যান-জ্ঞান, জীবনের পাথেয়।
শৈশবে অবশ্য কেবল ক্রিকেট নয়, আরও অনেক খেলাই খেলেছেন বার্গার। ১৫ বছর বয়সে যেমন বয়সভিত্তিক আঞ্চলিক টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপের শীর্ষ খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন তিনি। ১৭ বছর বয়সে খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোয়াশ ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে। তবে পিঠের চোট তাকে মনোযোগী করে তোলে ক্রিকেটে। অবশ্য কখনোই পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার।
ক্রিকেটে সামর্থ্যের ছাপ রেখেই ২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব দা ভিতভাতেরসর্যান্ডে (ডব্লিউআইটিএস) বিনা খরচে পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে যান বার্গার। সেটি আর হাতছাড়া করেননি ওই সময়ের ১৮ বছর বয়সী পেসার। ভর্তি হয়ে যান মনোবিজ্ঞানে। এক দশক আগে নেওয়া সেই সিদ্ধান্তে পুরোই পাল্টে গেছে তার জীবন।
এখন বার্গারের বয়স ২৮ বছর। এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে তিন সংস্করণে খেলে ফেলেছেন তিনি; দুটি টেস্ট, তিনটি ওয়ানডে ও একটি টি-টোয়েন্টি। দলটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজনও হয়ে উঠছেন বাঁহাতি এই পেসার। দিন দুয়েক আগে দক্ষিণ আফ্রিকার কেন্দ্রীয় চুক্তিতেও প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
শুধু তাই নয়, বর্তমানে সব ক্রিকেটারের জন্য কাঙ্ক্ষিত টুর্নামেন্ট আইপিএলেও সুযোগ পেয়ে গেছেন বার্গার। খেলছেন রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে পেছনে ফিরে তাকালেন তিনি। শোনালেন তার পেশাদার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প।
“শুনতে অদ্ভুত লাগছে, তাই না। যারা ক্রিকেট খেলে তাদেরকে ফুল ফ্রি স্কলারশিপের সুযোগ করে দেয় উইটস (বিশ্ববিদ্যালয়)। আমার মনে হলো, এটা দারুণ সুযোগ। আমি আসলে ক্রিকেটার হতে চাইনি, কিন্তু বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম, তখন মনে হলো কেন না? ক্রিকেটটা মূলত আমার পড়ালেখার ব্যাক-আপ ছিল (হাসি)।”
পিঠের চোট থেকে সেরে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেটে অংশ নেন বার্গার। তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ পেসার হওয়ার সম্ভাবনা দেখেন উইটসের কোচ নিল লেভেনসন। তবে নিজের বোলিং নিয়ে তখনও সেভাবে ভাবতেনই না বার্গার।
“তার (কোচের) কথায় প্রথমে আমি হেসেছিলাম। আর বলেছিলাম, ‘আমি বল করি ঘণ্টায় ১২৫ কিমি গতিতে। এটা দিয়ে জীবন চালানো যাবে না। আমি অনেককে ঘণ্টায় ১৪৫ কিমি গতিতে বল করতে দেখেছি।’ এরপর তাকে বললাম, ‘ঠিক আছে, একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।‘”
“বাড়ির উঠানে বন্ধুদের সঙ্গে, বাবা-মায়ের সঙ্গে সবসময়ই ক্রিকেট খেলতাম। তবে বলব না, পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল।”
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অনুশীলন করতে করতে একটা ভালো লাগা কাজ করতে থাকে বার্গারের। পেশাদার ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে বোলিং করার তাড়নাও অনুভব করেন। তার সেই চাওয়াও দ্রুত পূরণ হয়ে যায়। সুযোগ পান জোহানেসবার্গের ফ্র্যাঞ্চাইজি দল হাইভেল্ড লায়ন্সের নেটে বোলিংয়ের।
সময়ের সঙ্গে ক্রিকেটে বার্গারের ভালোলাগা বাড়তে থাকে আরও। ২০১৬-১৭ মৌসুমের কথা, মনোবিজ্ঞানে ডিগ্রি পেতে তখন তার আর বাকি ৬ মাসের মতো, সেই সময় জীবনের এক টার্নিং পয়েন্টে এসে দাঁড়ান তিনি, নিতে হয় বড় এক সিদ্ধান্ত। কেপ কোবরাস থেকে ক্যারিয়ারের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি চুক্তির প্রস্তাব পান, তবে তাতে সাড়া দিতে হলে ‘ছেড়ে দিতে হবে’ পড়ালেখা।
“আমি লেখাপড়া স্থগিত করে জো’বার্গ ছেড়ে চলে যাই। কারণ, বাইরে থেকে কোর্সটি করার অনুমতি ছিল না। আবার আমার (কেপ কোবরার সঙ্গে) চুক্তির কারণে আমাকে কেপ টাউনে থাকতে হতো। তাই আমি সব কিছু ছেড়ে ক্রিকেটে মনোযোগ দেই।”
বার্গারের ওই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, তার যথার্থতা মিলতে থাকে অল্প সময়েই। গত বছর পেয়ে যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদও। ক্রিকেটকে জীবনের লক্ষ্য বানাতে যে প্রদেশ ছেড়েছিলেন, সেই জোহানেসবার্গেই গত ডিসেম্বরে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম মাঠে নামেন তিনি, ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে। ওই মাসে হয়ে যায় তার ওয়ানডে ও টেস্ট অভিষেকও।
ওই সময়ের কথা উঠতেই বার্গার বললেন, “জীবনের এমন রূপ বদল দারুণ মজার, তাই না?”
১৯ ডিসেম্বর ওয়ানডে অভিষেকের দিন আইপিএলে দল পাওয়ার কথা জানতে পারেন বার্গার। তাকে ৫০ লাখ রুপিতে দলে নেয় রাজস্থান। সেটিও ছিল মজার এক ঘটনা। ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচে ৩০ রানে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
“যখন আমি মাঠ ছাড়ছিলাম, পমি (এমবাঙ্গোয়া) ও শন পোলক বলছিল, ‘ভালো বল করেছ এবং অভিনন্দন।’ আমি ভাবছিলাম, তিন উইকেট নেওয়ার জন্য সাধুবাদ? ১০ ওভার করার জন্য অভিনন্দন? এটা আমার অভিষেক ম্যাচও ছিল না, আমি তাই কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যাই। আমি ড্রেসিং রুমে গিয়ে কাপড় বদলে ফের মাঠে আসি।”
“শন বলল, ‘আমি নিশ্চিত তুমি খুবই রোমাঞ্চিত।’ তখনও আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না, তাই বললাম, ‘হ্যাঁ, দারুণ, আমার মনে হয়, ওয়ানডেতে প্রথম উইকেট পেয়েছি, তাই দারুণ লাগছে।’ তখন তিনি বললেন, ‘আরে না, আমি বলতে চাচ্ছি আইপিএলের জন্য। তুমি রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলতে যাচ্ছ’।”
টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার খবরও নাটকীয়ভাবে জানতে পারেন বার্গার।
“আমরা টাইটান্সের বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচ খেলছিলাম… আমরা দ্বিতীয় দিনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। মাঠে নামার ঠিক আগে শুকরির (কনরাড, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান কোচ) ফোন পেলাম।”
“তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে শুধু এটুকুই জানাচ্ছি যে, সোমবার ভারত সিরিজের জন্য টেস্ট দল ঘোষণা করা হবে। এতে তোমার নাম থাকবে, অভিনন্দন।’ এটা মাঠে নামার ঠিক আগ মুহূর্ত। আমি নিজেকে বললাম, ‘ওয়াও, চাপ নেওয়া যাবে না’ (হাসি)।”
টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার খবর পাওয়ার পরও সবার কাছে শুরুতে গোপন রাখেন বার্গার। সেঞ্চুরিয়নে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তার। ওই ম্যাচে যে খেলবেন, সেটিও পরিবারের অনেককে শুরুতে জানাননি তিনি।
“আমার দুলাভাই, ভাগ্নি, বাবা-মা, সঙ্গিনী-সবাই সঙ্গেই ছিল। আমি তাদের বলেছিলাম যে, আমি খেলছি না, যাতে তারা আমাকে টেস্ট ক্যাপটি পেতে দেখলে বিস্মিত হয়।”
“কিন্তু আমার বাবা যখন আমাকে রানআপ মার্ক করতে দেখলেন, তখনই তিনি বুঝে যান। তিনি দূর থেকে আমাকে ‘থাম্বস-আপ’ দেখালেন, যেন বলতে চাইছেন, 'চিন্তা করো না, আমি জানি, তুমি খেলছ’।”
জয়ের আনন্দে অভিষেক টেস্ট রাঙান বার্গার। ভারতকে ইনিংস ও ৩২ রানে হারানো ম্যাচে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৩টি ও ৪টি উইকেট নিয়ে বড় অবদান রাখেন তিনি।
ওই ম্যাচের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বললেন, “টেস্ট ক্যাপ পাওয়া, টেস্ট অভিষেকেই জয় পাওয়া দারুণ ব্যাপার।”
স্ট্রেস ফ্র্যাকচার চোটে ২০২২ সালের অক্টোবরের আগ পর্যন্ত এক বছরের বেশি সময় কোনো ধরনের ক্রিকেট খেলেননি বার্গার। এরপরও বছর ঘুরতেই যে জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যাবেন, কল্পনাতেও ছিল না তার। সঙ্গে আইপিএলে সুযোগ পাওয়াও তার জন্য অনেক বড় অর্জন।