বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজ
৭ ছক্কায় গুরবাজের সেঞ্চুরি, ওমারজাইয়ের অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স আর বাংলাদেশের বাজে ফিল্ডিং মিলিয়ে শেষ ওয়ানডে জিতে সিরিজ জিতে নিল আফগানিস্তান।
Published : 12 Nov 2024, 12:27 AM
প্রাচীন এক ইংলিশ প্রবাদে আছে, ‘আ ক্যাট হ্যাজ নাইন লাইভস।’ রাহমানউল্লাহ গুরবাজের জীবন কয়টি, সেটিই যেন পরখ করতে চাইছিলেন বাংলাদেশের ফিল্ডাররা। ২৪ রানে ক্যাচ, ৪৮ রানে রান আউট, ৫৬ রানে স্টাম্পিং, ৮২ রানে আবার রান আউট- সুযোগের পর সুযোগ পেলেন আফগান ওপেনার। শেষ পর্যন্ত যখন আউট হলেন, ততক্ষণে তার সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। আজমাতউল্লাহ ওমারজাইকে তো শেষ পর্যন্ত ফেরানোই গেল না। এই দুজনের কাছেই পিষ্ট হলো বাংলাদেশের আশা।
দুটি একতরফা ম্যাচের পর সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচটিতে কিছুটা ফাইনালের আমেজ এলো। খানিকটা লড়াই হলো। তবে শেষের উত্তেজনা জমতে না দিয়ে দারুণ পারফরম্যানেন্স জিতে গেল আফগানিস্তান। ৫ উইকেটের এই জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে নিল তারা।
আগের দুই ম্যাচে পরে বোলিং করা দল বাড়তি সুবিধা পেয়ে জিতেছিল বড় ব্যবধানে। শারজাহতে সোমবার শেষ ম্যাচে দেখা গেল উল্টো চিত্র। ২৪৫ রান তাড়ায় আফগানরা জিতে গেল ১০ বল বাকি রেখে।
বিপর্যয়ের মধ্যে মাহমুদউল্লাহর ৯৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস ও নেতৃত্বের অভিষেকে মেহেদী হাসান মিরাজের ফিফটিতে বাংলাদেশ তোলে ৫০ ওভারে ২৪৪ রান। তবে তাদেরকে পরে আড়াল করে দেন গুরবাজ ও ওমারজাই।
প্রথম দুই ম্যাচে ব্যর্থ গুরবাজ ৫ চার ও ৭ ছক্কায় খেলেন ১০১ রানের ইনিংস। অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ক্যারিয়ারে প্রথমবার ৪ উইকেট শিকার করার পর ব্যাট হাতে ম্যাচ জেতানো ইনিংস উপহার দেন ওমারজাই। আগের দুই ম্যাচেই শূন্য রানে আউট হওয়া ক্রিকেটার এবার ৫ ছক্কায় করেন অপরাজিত ৭০।
দুই দলের চার সিরিজের প্রথম দুটি জিতেছিল বাংলাদেশ। এরপর টানা দুটি জিতে নিল আফগানিস্তান।
কিছুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো আফগানরা সাফল্যের ধারা ধরে রাখল টানা তিনটি সিরিজ জিতে।
সিরিজের আগের ম্যাচগুলোর ধারা অনুযায়ী ২৪৪ রানের পুঁজি নিয়ে আত্মবিশ্বাসীই থাকার কথা ছিল বাংলাদেশের। তবে বোলিংয়ের শুরুটা তাদের ছিল দুই প্রান্তে দুইরকম। একদিকে গতি আর বাউন্সে আফগান ওপেনারদের কাঁপিয়ে দেন নাহিদ রানা। তার একটি বলের গতি ছিল ১৫০.৯ কিলোমিটার। আরেক দিকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে শরিফুল ইসলামকে দুই দফায় বিশাল ছক্কায় উড়িয়ে দেন গুরবাজ।
শরিফুলের প্রথম তিন ওভার থেকে রান আসে ২৪, রানার প্রথম তিন ওভার থেকে কেবল ছয়!
প্রথম ব্রেক থ্রু এনে দেন রানাই। প্রায় ১৪৮ কিলোমিটারের এক গোলায় বোল্ড করে দেন তিনি সেদিকউল্লাহ আটালকে।
দুই প্রান্তে দুই ছবি ফুটে উঠতে থাকে পরের সময়টাতেও। রানা আক্রমণ থেকে সরে যাওয়ার পর মুস্তাফিজুর রহমানের ওপর চড়াও হন গুরবাজ। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ পেসারের দুটি শর্ট বলে ছক্কা মারেন তিনি। আরেক প্রান্তে অস্বস্তিময় সময় কাটিয়ে মুস্তাফিজের বলেই আউট হন রেহমান শাহ (২২ বলে ৮) ও হাশমাতউল্লাহ শাহিদি (২১ বলে ৬)।
ম্যাচের লাগাম তখন বাংলাদেশের হাতে। কিন্তু গুরবাজ ক্রিজে থাকা মানে তো চাপ সরে যাওয়া স্রেফ সময়ের ব্যাপার! তার ব্যাটে চার-ছক্কার ফোয়ারা ছুটতে থাকে। বারবার জীবন দিয়ে তার পাশে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেয় ফিল্ডাররা। পয়েন্টে ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হন বদলি ফিল্ডার রিশাদ হোসেন, সরাসরি থ্রোয়ে বল স্টাম্পে লাগাতে পারেননি তাওহিদ হৃদয়, স্টাম্পিং করতে পারেনি জাকের আলি, রান আউটের সুযাগ হাতছাড়া হয় পরে আরেকবার।
তার সঙ্গে দারুণ খেলতে থাকেন ওমারজাই। এক-দুই নেওয়ার পাশাপাশি সুযোগ পেলেই বড় শট খেলে রান রেট নাগালে রেখেছেন দুজন।
সৌম্য সরকারকে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কায় ওড়ানোর পর সিঙ্গেল নিয়ে ১১৭ বলে শতরান স্পর্শ করেন গুরবাজ।
আফগানিস্তানের হয়ে সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ড আগে থেকেই ছিল তার। সেটিই আরেকটু সমৃদ্ধ করলেন ২২ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। স্রেফ ৪৬ ম্যাচেই তার সেঞ্চুরি হলো ৮টি, ফিফটি ৬টি। বাংলাদেশের বিপক্ষে ১১ ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেন তিনটি।
সেঞ্চুরির পরপর আরেকটি ছক্কার চেষ্টায় শেষ হয় তার ইনিংস। জুটি থামে ১০০ রানে। পরে গুলবাদিন নাইবকে দ্রুত বিদায় করেন নাহিদ রানা।
কিন্তু ওমারজাই ও মোহাম্মাদ নাবি ম্যাচে ফিরতে দেননি বাংলাদেশকে। দারুণ ব্যাটিংয়ে ৪৮ বলে ৫৮ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দুজন শেষ করে দেন ম্যাচ।
২৭ বলে ৩৪ রানে অপরাজিত থাকেন নাবি। ছক্কায় ম্যাচ শেষ করে হুঙ্কার ছুড়ে উদযাপন করেন ওমারজাই।
অথচ ম্যাচের শুরুটা বাংলাদেশের জন্য ছিল আশা জাগানিয়া। আগের দুই ম্যাচ একই উইকেটে হলেও এই ম্যাচ ছিল ভিন্ন পিচে। নাজমুল হাসান শান্তর চোটে নেতৃত্ব পাওয়া মিরাজ টস জিতে অনুমিতভাবেই বেছে নেন ব্যাটিং।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে ‘মিনি ধস’ নামে এ দিনও। তবে এর আগে ছিল কার্যকর একটি জুটি, পরে গড়ে ওঠে বিশাল জুটি।
তানজিদ হাসান ও সৌম্য সরকার উদ্বোধনী জুটিতে ৫৩ রান তোলে ৫১ বলে। তবে দুজনের কেউ বড় করতে পারেননি ইনিংস।
যথারীতি দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি শট খেলার পর বাজে শটে উইকেট হারান সৌম্য। আগের দুই ম্যাচে ৩৩ ও ৩৫ রানের পর এবার তার রান ২৪। পরের ওভারেই বিদায় নেন তানজিদ। শূন্য ও সাত রানে জীবন পেয়ে তিনি যেতে পারেন ১৯ পর্যন্ত।
শান্তর জায়গায় সুযোগ পেয়ে প্রায় ১৪ মাস পর ওয়ানডে খেলতে নামা জাকির হাসানকে ৪ রানে বিদায় করে দেয় নানগেলিয়া খারোটের সরাসরি থ্রো। পাঁচ রানের মধ্যে তিন উইকেট হারিয়ে ফেলা দল একটু পর আরও চাপে পড়ে যায় তাওহিদ হৃদয়কে (৭) হারিয়ে।
হঠাৎ টালমাটাল হয়ে পড়া ইনিংসকে সামাল দেন মিরাজ ও মাহমুদউল্লাহ। টানা ৫১ বলে বাউন্ডারি আসেনি। কিন্তু অস্থির হননি কেউ।
মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে অবশ্য কোনো অস্বস্তি ছিল না। স্রেফ ঝুঁকি নেননি তিনি পরিস্থিতির কারণে। মিরাজ পুরোপুরি মন দেন উইকেট ধরে রেখে জুটি গড়ে তোলায়।
নিজেদের চেষ্টায় সফল হন দুজনই। ৬৩ বলে ফিফটি করেন মাহমুদউল্লাহ। মিরাজের পঞ্চাশ আসে ১০৬ বলে, গত ১৯ বছরে যা বাংলাদেশের মন্থরতম ফিফটি।
পরে রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন দুজনই। ফিফটির আগে-পরে মোহাম্মাদ নাবিকে দুটি ছক্কা মারেন মাহমুদুল্লাহ। আজমাতউল্লাহ ওমারজাইকে টানা দুটি বাউন্ডারির পর ওই ওভারেই আউট হন মিরাজ (১১৯ বলে ৬৬)।
জাকের আলি, নাসুম আহমেদরা আগের ম্যাচের ব্যাটিংটা করতে পারেননি। শেষ চার ওভারে বাংলাদেশ কেবল একটি বাউন্ডারিই পায়। ফাজালহাক ফারুকির স্লোয়ার উড়িয়ে সীমানা ছাড়া করেন মাহমুদউল্লাহ।
৯৬ রান নিয়ে শেষ ওভার শুরু করেন তিনি স্ট্রাইকে থেকে। কিন্তু বড় শট খেলতে পারেননি। সেঞ্চুরির জন্য শেষ বলে তার প্রয়োজন ছিল তিন রান। কিন্তু টাইমিং করতে পারেননি ঠিকঠাক। ক্লান্তময় দৌড়ে দ্বিতীয় রান নেওয়ার চেষ্টায় রান আউট হয়ে যান।
দুই রানের জন্য সেঞ্চুরি না হওয়া আক্ষেপ নিশ্চয়ই তার ছিল। তবে ২৪৪ রান নিয়ে ড্রেসিং রুমে স্বস্তির আবহও ছিল। মাঝবিরতিতে টিভি সাক্ষাৎকারে শান্ত বলেন, এই রান নিয়ে তারা খুবই খুশি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে খুশি কেড়ে নিলেন গুরবাজ ও ওমারজাই। ট্রফি নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠল গোটা দল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৪৪/৮ (তানজিদ ১৯, সৌম্য ২৪, জাকির ৪, মিরাজ ৬৬, হৃদয় ৭, মাহমুদউল্লাহ ৯৮, জাকের ১, নাসুম ৫, শরিফুল ২*; ফারুকি ৭-০-৪১-০, গাজানফার ৭-০-৪৯-০, ওমারজাই ৭-০-৩৭-৪, নাবি ১০-২-৩৭-১ খারোটে ৯-০-৩৫-০, রাশিদ ১০-০-৪০-১)
আফগানিস্তান: ৪৮.২ ওভারে ২৪৬/৫ (গুরবাজ ১০১, আটাল ১৪, রেহমাত ৮, শাহিদি ৬, ওমারজাই ৭০*, নাইব ১, নাবি ৩৪* ; শরিফুল ৮.২-০-৬১-০, নাহিদ ১০-১-৪০-২, নাসুম ১০-২-২৪-০, মুস্তাফিজ ৯-০-৫০-২, মিরাজ ১০-০-৫৬-১, সৌম্য ১-০-১২-০)
ফল: আফগানিস্তান ৫ উইকেটে জয়ী
সিরিজ: তিন ম্যাচের সিরিজে আফগানিস্তান ২-১ ব্যবধানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: আজমাতউল্লাহ ওমারজাই
ম্যান অব দা সিরিজ: মোহাম্মাদ নাবি