বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ
একটুর জন্য সেঞ্চুরি করতে না পারলেও অসাধারণ ব্যাটিং করে বাংলাদেশের লিড তিনশর কাছে নিয়ে গেছেন জাকের আলি।
Published : 04 Dec 2024, 12:28 AM
আলজারি জোসেফের শর্ট বলটিতে সপাটে ব্যাট চালিয়ে দিলেন জাকের আলি। বল উড়ে গেল সীমানার বাইরে। ছক্কায় ফিফটি ছুঁয়ে তিনি উদযাপন করলেন পেশি দেখিয়ে। অমন দাপুটে শটের পর পেশি একটু দেখাতে পারেন বটে!
ক্যারিবিয়ানদের মতো অতটা পুষ্ট পেশি অবশ্য নয় তার। তবে সেখানে জোর যে কম নেই, তা দেখিয়ে দিলেন তিনি পরের সময়টাতেও। ওই ছক্কার এক বল পরই আরেকটি ছক্কা, এবার হুক শটে। পরের ওভারে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো করেই গ্যালারিতে আছড়ে ফেললেন কিমার রোচকে। দুর্দান্ত সব শটের পসরা সাজিয়ে দ্রুত দলের লিড নিয়ে গেলেন তিনশর কাছে। নিজে পৌঁছে গেলেন শতরানের কাছে।
শেষ পর্যন্ত যদিও সেঞ্চুরির স্বাদ তিনি পেলেন না। তবে জ্যামাইকায় যে ইনিংসটি উপহার দিলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।
পরিস্থিতির দাবি মেটাতে একটি আদর্শ টেস্ট ইনিংসে যা যা দরকার, সব ছিল তার ব্যাটিংয়ে। বরং ছিল যেন আরও বেশি কিছু! স্কিল, মানসিক শক্তি, সাহসিকতা, লড়িয়ে মনোভাব, বুদ্ধিমত্তা, ম্যাচ সচেতনতা, পেশি শক্তির প্রদর্শনী, পরিপক্কতা, দাপট, কর্তৃত্ব… কী ছিল না তার ইনিংসে!
বড় শটের চেষ্টায় আউট হয়ে সেঞ্চুরিটা পেলেন না তিনি ৯ রানের জন্য। তবে ৮ চার ও ৫ ছক্কায় ১০৬ বলে ৯১ রানের ইনিংসটি নিশ্চিতভাবেই জায়গা পেয়ে গেছে বাংলাদেশে টেস্ট ইতিহাসের ধ্রুপদি ইনিংসগুলোর তালিকায়।
জাকেরের লড়াইয়ের শুরু আগের দিন। বেশ সাবলিল ব্যাটিংয়ে ৪৯ বলে ২৯ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। চতুর্থ দিনে মঙ্গলবার ১০ ওভার হওয়ার আগেই ভেঙে যায় তাইজুল ইসলামের প্রতিরোধ। অসুস্থতার কারণে আগের দিন ব্যাটিংয়ে নামতে না পারা মুমিনুল হক এ দিন নেমে আউট হয়ে যান শূন্য রানেই। বাংলাদেশের ইনিংস তখন দ্রুত গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়।
কিন্তু জাকের আলির ব্যাটে দূর হলো দলের দুর্ভাবনা। দলের পরিস্থিতি উপলব্ধি করে ব্যাটিংয়ের ধরন বদলে ফেললেন তিনি। হাতের সব শটের প্রদর্শনী মেলে ধরলেন যেন। তার জন্য শর্ট বলের কৌশল বেছে নিলেন ক্যারিবিয়ান পেসাররা। তিনি জবাব দিলেন পুল-হুক খেলার স্কিল আর সাহস দিয়ে।
‘সাহস’ ব্যাপারটি এ দিন তার ব্যাটিংয়ে লেপ্টে ছিল প্রবল গর্ব নিয়ে। পরিস্থিতি বা প্রতিপক্ষ তাকে ভড়কে দিতে পারেননি। বরং পাল্টা জবাব দিয়ে তিনিই হয়ে উঠেছেন সময়ের রাজা।
লড়িয়ে ক্রিকেটার হিসেবে একটা পরিচিতি বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার ছিল আগে থেকেই। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টে দুটি ফিফটি করে তিনি নিজের সেই দিকটি মেলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও। এবার এই ইনিংসটিতে দেখালেন, তিনি বিশালহৃদয় ক্রিকেটার, যিনি দলের ভার বইতে পারেন ভরসা ও দাপটের প্রতিচ্ছবি হয়ে।
চতুর্থ দিনে ৫ উইকেট হারিয়ে ৭৫ রান যোগ করেছে বাংলাদেশ। জাকের একাই করেছেন সেখানে ৬২ রান!
বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রথম তিন টেস্টেই পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস খেলার কীর্তি গড়লেন। প্রথমজন ছিলেন জাকির হাসান। তার সেই তিন ইনিংসের একটি ছিল সেঞ্চুরি। লোয়ার অর্ডার থেকে আরেককটু সমর্থন পেলে হয়তো সেঞ্চুরি পেতেন জাকেরও। তবে বাংলাদেশের শেষ চার ব্যাটসম্যান মিলে করতে পারলেন মোটে চার রান।
জাকের নিজেও হয়তো আরেকটু ‘স্মার্ট’ হতে পারতেন। হাসান মাহমুদ ও তাসকিন আহমেদকে একটু আড়াল করে নিজে স্ট্রাইক রেখে খেলার চেষ্টা করতে পারতেন। কিংবা শেষ জুটিতে হয়তো আরেকটু কৌশলি হতে পারতেন। তবে যেভাবে টাইমিং হচ্ছিল তার, বড় শটে যতটা কার্যকর হচ্ছিলেন, নিজের শতরানের কথা না ভেবে হয়তো চার-ছক্কায় দলের রান কিছু বাড়ানোর ভাবনাই ছিল তার।
তবে ইনিংসজুড়ে প্রায় সবকিছুই নিখুঁত করেছেন যিনি, তাকে তো ‘যদি-কিন্তু-হয়তো’ দিয়ে আটকে রাখা কঠিন। বরং এই ইনিংসে জাকের দেখালেন, তিনি কতটা বন্ধনহীন। বাংলাদেশ যদি ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত জিতে যায়, বড় একটি কারণ হবে জাকেরের ইনিংস। অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও মূল্যবান ইনিংস হিসেবে তখন এটি জ্বলজ্বল করবে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে।