দলকে জিতিয়েই রনির তৃপ্তি

প্রায় ৮ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নতুন অধ্যায় শুরুর পর প্রথম ফিফটির দেখা পেলেন ৩২ বছর বয়সী ওপেনার, তবে তার বেশি ভালো লাগছে দলকে জেতাতে পেরে।

শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদচট্টগ্রাম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2023, 04:17 PM
Updated : 27 March 2023, 04:17 PM

'আমি ম্যাচ জেতাতে চাই'- প্রায় ৮ বছর পর জাতীয় দলে ফিরে এভাবেই নিজের লক্ষ্যের কথা বলেছিলেন রনি তালুকদার। খুব বেশি সময় লাগল না তার সেই লক্ষ্য পূরণ করতে। শুরুতে ছিল কিছুটা ইঙ্গিত, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে তা পেল অনেকটাই পূর্ণতা। ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক ফিফটি করে দলকে জিতিয়ে ৩২ বছর বয়সী ওপেনার পেলেন ম্যাচ সেরার স্বীকৃতি।

চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে সহজাত ব্যাটিংয়ে শুরু থেকেই দ্যুতিময় ছিলেন লিটন দাস। তিনি যখন ছন্দে থাকেন, বেশিরভাগ সময়ই অপরপ্রান্তের ব্যাটসম্যান স্রেফ দর্শক বনে যান। তবে এ দিন রনি ছিলেন পুরো ভিন্ন ভূমিকায়। লিটনের বিধ্বংসী যাত্রায় তিনিও ছিলেন সঙ্গী। কখনও কখনও তো লিটনের চেয়েও বেশি আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা যায় তাকে।

তৃতীয় বলেই দারুণ পুল শটে ছক্কা মেরে নিজের অভিপ্রায় পরিষ্কার করে দেন রনি। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে ঝড় বইয়ে দেন মার্ক অ্যাডায়ারের ওপর দিয়ে। বোলারের মাথার ওপর দিয়ে দারুণ এক ছয়ের পর টানা তিন চার মারেন কভার পয়েন্ট ও ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের আশপাশ দিয়ে। তার ওই ওভারের ঝড়ে পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ গড়ে নিজেদের রেকর্ড ৮১ রান।

উদ্বোধনী জুটিতে শতরান আসার আগেই লিটন ফিরে গেলেও দাপুটে ব্যাটিং চলতে থাকে রনির। ক্যারিয়ারের পঞ্চম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নেমে ৬ চারের সঙ্গে ২টি ছয়ে স্রেফ ২৪ বলে করেন নিজের প্রথম ফিফটি। বাংলাদেশের হয়ে এর চেয়ে কম বলে ফিফটি আছে স্রেফ দুইটি। 

এমন ঝড়ো ফিফটির নজির সবশেষ বিপিএলেও দেখিয়েছেন রনি। টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে স্রেফ ১৯ বলে পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলেন রংপুর রাইডার্সের এই ওপেনার। বিপিএলে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যা দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। 

বিপিএলে ১৩ ম্যাচে ১২৯.১৭ স্ট্রাইক রেটে তিন ফিফটির সৌজন্যে আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২৫ রান করেন রনি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে রনি জানালেন, বিপিএলের মতো ব্যাটিংয়ের পরিকল্পনাই ছিল তার।

“বিপিএলেও যদি দেখেন, আমি এই (আগ্রাসী) খেলাটাই পছন্দ করি। পাওয়ার প্লেতে একটু মেরে খেলতে চাই। আজকেও সেটাই চেষ্টা করেছি। যে ধরনের খেলাটা আমি খেলতে পছন্দ করি, ওটাই খেলে যেতে চাই সবসময়।”

বিপিএলের পর আন্তুর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেও বাংলাদেশের রেকর্ডটি নিজের করে নেওয়ার প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন রনি। পাওয়ার প্লেতে স্রেফ ১৭ বলেই করে ফেলেছিলেন ৩৮ রান। পরের দুই বলে দুটি ছক্কা হলেই আশরাফুলের ২০ বলে ফিফটির রেকর্ড নিজের করে ফেলতে পারতেন নারায়ণগঞ্জের এই ক্রিকেটার। 

সেটি করতে পারেননি। পারেননি লিটনের করা ২১ বলে ফিফটির রেকর্ড ভাঙতে। তবে প্রাপ্তি কম নেই। ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটির ইনিংসে করেছেন ৭ চার ও ৩ ছয়ে ৩৮ বলে ৬৭ রান। ডাক-ওয়ার্থ লুইস স্টার্ন মেথডে বাংলাদেশের ২২ রানের জয়ের পর তাকে বেছে নেওয়া হয় ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফরম্যান্স করে ২০১৫ সালে প্রথমবার স্কোয়াডে আসেন রনি। ওই বছর লিস্ট 'এ' সংস্করণের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ৫১ গড়ে আসরের সর্বোচ্চ ৭১৪ রান করেন তিনি। পরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের ওয়ানডে দলে সুযোগ পেলেও অভিষেক হয়নি তার। 

কিছুদিন পর প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান টি-টোয়েন্টি সংস্করণে। এমনিতে টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওই ম্যাচে তাকে নামানো হয় সাত নম্বরে। বাংলাদেশের ৩১ রানে পরাজয়ের ম্যাচে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১ রান করেন রনি। 

ওই ম্যাচের পর দীর্ঘ বিরতি পড়ে রনির ক্যারিয়ারে। ঘরোয়া ক্রিকেটে গড়পড়তা প্রতি মৌসুমেই রান করেন তিনি। তবে দেখা যায় ধারাবাহিকতার অভাব। সেটিও কাটিয়ে ওঠেন সবশেষ বিপিএলে। রংপুরের হয়ে পুরো আসরেই ভালো খেলার পুরস্কারও পান ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দলে সুযোগ পাওয়ার মাধ্যমে।

মাঝে ঠিক ১০০ ম্যাচের বিরতি দিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে মূল একাদশে ফেরেন রনি। যা বাংলাদেশের রেকর্ড। ওই ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ১৪ বলে ২১ রান। বড় কিছু না হলেও স্যাম কারান, ক্রিস ওকসদের বিপক্ষে সাহস ও মানসিকতা ফুটিতে তুলতে পারেন ক্রিজে ছোট্ট উপস্থিতিতেই। দীর্ঘ দিন পর ফিরে আড়ষ্টতায় না ভুগে লক্ষ্য তাড়ায় যেমন শুরু দরকার ছিল, চেষ্টা করেন পরিস্থিতির সেই দাবি মেটানোর।  

ওই সিরিজের তিন ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ৫৪ রান। ফেরাটা তেমন দারুণ কিছু না হলেও ইতিবাচক মানসিকতায় কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে মুগ্ধ করেন তিনি। সেই পথ ধরেই সুযোগ পান আইরিশদের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দলেও। বদলি হিসেবে স্কোয়াডে এসে অবশ্য ৮ বছর আগের মতো এবারও ওয়ানডে অভিষেক হয়নি তার। 

তবে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচেই দিলেন নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ। দারুণ ব্যাটিংয়ের দলকে জিতিয়ে নিজের লক্ষ্যের সেই পুরোনো কথাই আরও একবার মনে করালেন তিনি।  

“সত্যি ভালো লাগার মতো একটা বিষয়। আমি সবসময়ই বলে আসছি, দলের জন্য কিছু করতে চাই। এটাই আমার মূল লক্ষ্য। দলের জন্য ভালো কিছু যেন করতে পারি, অবদান রাখতে পারি, এটাই চেষ্টা থাকে।”

“ম্যাচ জিতলে তো অবশ্যই ভালো লাগে। কারণ সবার আগে দল। আর ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স করতে পারাটা সত্যিই অনেক ভালো লাগার একটি বিষয়।”  

দলকে জিতিয়ে ম্যাচ সেরার স্বীকৃতি পেলেও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে রনি নিজে সেটি গ্রহণ করতে পারেননি। ফিল্ডিংয়ের সময় ডাইভ দিয়ে কাঁধে ব্যথা পান তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিজের হাতে নিতে পারলেন না, কিছুটা আক্ষেপ ফুটে উঠল তার কণ্ঠে।   

“পুরস্কার বিতরণের সময় (কাঁধে) অনেক ব্যথা করছিল। একদমই নড়তে পারছিলাম না। নিজ হাতে (ম্যান অব দা ম্যাচ পুরস্কার) নিতে পারলে আমারও অনেক ভালো লাগত।”

দীর্ঘ দিন পর দলে ফেরার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে রনি বলেছিলেন, তার এই খবর বাবাকে দিতে পারলে আরও ভালো লাগত তার। ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সের দিনও বাবার কথাই বেশি করে মনে পড়ছে তার। 

২০১৪ সালে মৃত্যুবরণ করায় বাবাকে নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের কিছুই দেখাতে পারেননি তিনি। তবে এখনও মায়ের কাছ থেকে পান সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। 

“ম্যাচের পর মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। মা খুব খুশি হয়েছেন। পরে আমার কাঁধের ব্যথার খোঁজখবর নিলেন। সাবধানে থাকতে বললেন। সব কিছু ঠিকঠাক করতে বলেছেন।”