টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযান, দেশের মানুষকে ভালো কিছু উপহার দিতে চান অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।
Published : 07 Jun 2024, 08:58 AM
নাজমুল হোসেন শান্ত সংবাদ সম্মেলন কক্ষে ঢুকে বসার পরপরই মাঠ থেকে ভেসে এলো দর্শকের গর্জন। পাশেই টিভি পর্দায় তাকিয়ে শান্ত দেখলেন, ছক্কা মেরেছেন শাহিন শাহ আফ্রিদি। সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে টিভিতে আরও কিছুক্ষণ খেলা দেখলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কী ভাবলেন, কে জানে! তবে ম্যাচ শেষে নিশ্চয়ই প্রেরণা কিছু পেয়ে গেছেন তিনি ও তার দল। পাকিস্তানকে যে শেষ পর্যন্ত নাটকীয়ভাবে হারিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র!
বাংলাদেশ দলকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হলে তা ভীষণ দুঃখজনক অবশ্যই। তবে দলের এখন যা অবস্থা, এরকম নানা উৎস থেকে উজ্জীবিত হওয়ার উপকরণ খুঁজতেই হচ্ছে। এই যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই কদিন আগে সিরিজ হেরে প্রবল সমালোচনার মুখে আছেন শান্তরা। এবার পাকিস্তানের বিপক্ষে দারুণ জয়টি যেমন যুক্তরাষ্ট্র দলটির চমকপ্রদ উন্নতির প্রমাণ, তেমনি বাংলাদেশও হয়তো নিজেদের হারের হতাশাকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলতে পারে।
সেটা হোক বা না হোক, কিছু একটা করার সময় এসে গেছে শান্তদের এবং সেটা শুরুতেই ও দ্রুত। যুক্তরাষ্ট্রের স্মরণীয় জয়ের মঞ্চ ডালাসের এই গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামেই শুক্রবার রাতে (বাংলাদেশ সময় শনিবার সকাল সাড়ে ৬টা) শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। অভিযান শুরুর ধাপেই থমকে যাওয়ার বার্তা আসতে পারে এই ম্যাচ হেরে গেলে।
প্রথম ম্যাচে হেরে যাওয়া শ্রীলঙ্কার জন্য এই ম্যাচ তো একরকম বাঁচা-মরার লড়াই। মরিয়া হয়েই নামবে তারা। বাংলাদেশ দলের জন্য তো পরিস্থিতি আগে থেকেই মরিয়া। সংবাদমাধ্যমে প্রবল সমালোচনা চলছে তাদের নানা কিছু নিয়ে। সামাজিক মাধ্যমেও ট্রল, সমালোচনা, হাসাহাসি, সবই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর থেকে অনুশীলন সেশনের চেয়ে দাওয়া খাওয়া কিংবা ক্রিকেটের বাইরের নানা ইভেন্টে যোগ দেওয়ার সেশন বেশি হয়েছে কি না, এসব নিয়ে ঠাট্টা হচ্ছে বেশ। ডালাসে প্রবাসী বাংলাদেশি বেশ কজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিরিজে বাংলাদেশ ইচ্ছে করেই হেরে গেছে বলে তাদের বদ্ধমূল ধারণা। খুবই স্পর্শকাতর ধারণা এসব, হয়তো হাস্যকরও। তবে দলকে নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কোন পর্যায়ে গেলে এরকম কিছু লোকে বিশ্বাস করে, তা ফুটে উঠছে এতে।
বিশ্বকাপ কাভার করতে বাংলাদেশ থেকে আসা সংবাদকর্মীদের মধ্যে অবশ্য বেশি আলোচনা দলের অনুশীলনের কমতি নিয়ে। ম্যাচের ভেন্যু গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে কেবল একদিন অনুশীলন করেছেন শান্তরা, বুধবার। মাঠ থেকে ৩০ মাইল দূরে একটি ইনডোর ক্রিকেট একাডেমিতেই অনুশীলন হয়েছে বেশি। একদমই মৌলিক কিছু সুযোগ-সুবিধার ইনডোর এটি, বিশ্বকাপ বা আন্তর্জাতিক ম্যাচের লড়াইয়ের যথাযথ প্রস্তুতি এখানে সম্ভব নয় কোনোভাবেই। এমনকি ম্যাচের আগের দিন দলের ঐচ্ছিক অনুশীলন হয়েছে এখানেই। যদিও গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামের নেটে অনুশীলনের সুযোগ ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ দল বেছে নিয়েছে ওই ইনডোরকেই। ম্যাচের আগের দিনের সেই অনুশীলনে ছিলেন না প্রধান কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহে। সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাব।
শান্ত অবশ্য তা স্বীকার করতে চাইলেন না। সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তুতির প্রশ্ন উঠল বেশ কিছু। অধিনায়ক ঘুরিয়েফিরিয়ে বারবারই দাবি করলেন, তারা দারুণভাবেই প্রস্তুত।
“প্রস্তুতির দিক থেকে বলতে গেলে সবাই ভালোভাবে প্রস্তুত। সুযোগ-সুবিধা যতটুকু ছিল, পুরোপুরি নেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা। সুযোগ-সুবিধার ভালো-মন্দ থাকবেই। এর ভেতর থেকে যতটুকু ভালো জিনিস নেওয়া যায়, আমরা চেষ্টা করেছি নেওয়ার। আমি মনে করি, খুব ভালোভাবেই ক্রিকেটাররা প্রস্তুত আছে।”
“সবাই খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে। সাম্প্রতিক সিরিজগুলো খুব ভালো যায়নি আমাদের বা ব্যাটাররা রান করেনি। তবে কালকে একটা নতুন দিন। আমরা কেউই জানি না কে ভালো খেলবে বা কে দলকে জেতাবে। তবে সবাই দলকে জেতানোর জন্য প্রস্তুত এবং ১৫ জনের সবার সেই সামর্থ্য আছে।”
সামর্থ্যের প্রমাণ অবশ্য রাখতে পারছেন না শান্তসহ দলের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। দুর্ভাবনা বা শঙ্কার যতটা আছে, বেশির ভাগই টপ অর্ডার ব্যাটিং নিয়ে। দুই অভিজ্ঞ লিটন কুমার দাস ও সৌম্য সরকার আর অধিনায়ক নিজে, সবার ফর্মের অবস্থা যাচ্ছেতাই। সবশেষ ভারতের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে দুজন ফিরেছেন শূন্য রানে, একজন করেছেন ৬ রান।
অধিনায়ক হিসেবে শান্তকে তবু আশার গান গাইতেই হয়। নতুন দিনে পুরোনো হতাশা পেছনে ফেলার আশায় আছেন তিনি।
“এটা সত্যি যে, টপ অর্ডার বাটসম্যানরা সাম্প্রতি সময়ে ভালো করেনি বা করছে না। তবে কালকের দিনটি পুরোপুরি নতুন দিন। যার যে জায়গায় ঘাটতি আছে, অনুশীলনে সেখানে শতভাগ দিচ্ছে। উন্নতির জায়গায় যদি বলেন, আগের জায়গা থেকে এখন সবাই ভালো অবস্থায় আছে। অনুশীলনে ও নেটে যেভাবে ব্যাটিং করেছি আমরা, তাতে মনে হয়েছে সবাই আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে।”
“আগে কী হয়েছে, এটা চিন্তা না করে… কালকে একটা নতুন দিন, জানি না কে ভালো খেলবে বা কে খারাপ করবে, নতুন দিনে শুরুটা ভালো করবে বা যে ব্যাটসম্যান সেট হবে, তার বড় দায়িত্ব খেলাটা ভালোভাবে শেষ করার। যেভাবে আমাদের ব্যাটাররা প্রস্তুতি নিয়েছে, সেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে ভালো ম্যাচ হবে।”
এখানকার উইকেট সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নেই শান্তর। টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে এখানে কানাডার ১৯৪ রান টপকে জিতেছে যুক্তরাষ্ট্র। আরেক ম্যাচে আবার নেপাল গুটিয়ে গেছে ১০৬ রানে, সেটি পেরিয়ে যেতে বেগ পেতে হয়েছে নেদারল্যান্ডসকে। বৃহস্পতিবার পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচে স্কোর ছিল আগের দুই ম্যাচের মাঝামাঝি। বাংলাদেশের ম্যাচ কোন উইকেটে, তা জানা নেই শান্তরও। ম্যাচের দিন উইকেট বুঝে মানিয়ে নেওয়ার আশা তার।
শান্তদেরকে ঘিরে দেশের মানুষের আশার জায়গায় অবশ্য বড় চোট লেগেছে দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে। তুমুল ক্রিকেট উন্মাদনার দেশেও এবার দলের প্রতি আশা অনেকেরই খুব কম। গত ১০ বছরে কোনো বিশ্বকাপে সম্ভবত দলকে ঘিরে আশার পারদ এতটা নিচে ছিল না।
তবে দল যখন মাঠে নামবে, গ্যালারিতে ঠিকই বাংলাদেশের সমর্থকদের জোয়ার থাকবে হয়তো। দেশে টিভি পর্দায় চোখ থাকবে কোটি কোটি মানুষের। শান্তও তা জানেন। সেই মানুষগুলির মন রাঙানোর প্রত্যয়ও শোনালেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
“দর্শকদের প্রত্যাশা তো সবসময় থাকেই। সবার আশা থাকে। সবাই চায় আমরা ভালো ক্রিকেট খেলি। সেই জায়গা থাকবেই। আমরাও চাই ভালো ক্রিকেট খেলে বাংলাদেশের মানুষদের যেন ভালো একটা ম্যাচ উপহার দিতে পারি। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা কীভাবে ম্যাচটিতে নিজেদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করছি এবং আমাদের যে শক্তির জায়গা আছে, সেভাবে ম্যাচটি খেলছি কি না। নিজেদের শক্তি অনুযায়ী খেলতে পারলে অবশ্যই ভালো একটি ম্যাচ আমরা খেলতে পারব।”
সত্যিই যদি তারা পারেন, তাদের প্রতি লোকের বিশ্বাস ও ভরসাও ফিরে আসবে। এই যে অমানিশা চলছে, তা কাটিয়ে হয়তো উঁকি দেবে নতুন সূর্য।