স্থানান্তর নয়, ক্যাম্পাস ‘সম্প্রসারণ’ চান জবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরান ঢাকার বর্তমান অংশটিকে রেখেই কেরানীগঞ্জে ক্যাম্পাসের সম্প্রসারণ চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2019, 07:55 AM
Updated : 21 April 2019, 08:10 AM

ব্রাক্ষ্ম স্কুল নামে ১৮৫৮ সালে আরমানিটোলায় যাত্রা করা উপমহাদেশের প্রাচীন বিদ্যাপীঠটির দেড় শতাব্দীর বিকাশ চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের বর্তমান ঠিকানায়।

শিক্ষার্থীদের আবাসনসহ নানা সংকট সমাধানে গত ৯ অক্টোবর কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক।

প্রায় ২০০ একর জমির ওপর এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।

নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পুরনো ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে, এমন খবরে গত অক্টোবরেই ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।

গত ২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের নকশা দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সভার ছবি ফেইসবুকে দিয়ে কেরানীগঞ্জের সন্তান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ক্যাম্পাস স্থানান্তরের কথা জানালে ফের সমালোচনা শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপূর্ণ সুবিধা পেতে ক্যাম্পাস সম্প্রসারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমর্থন থাকলেও, বর্তমান ক্যাম্পাস হারাতে চান না তারা।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মিফতাহ আল ইহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূখণ্ড যত ছোটই হোক না কেন, এ জায়গাটার একটা গুরুত্ব আছে, ঐতিহ্য আছে। স্থানান্তর নয়, আমরা অবশ্যই সম্প্রসারণ চাই।

“ছাত্রদের প্রাণের স্পন্দন যে জায়গাটা, সেটা আমাদের হারাতে হচ্ছে; অথচ আমরা চেয়েছিলাম সম্প্রসারণ। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা একাডেমিক কোনো কাজে, গবেষণাগার বা হল হিসেবে রাখতে পারত।”

একই দাবি জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক রাইসুল ইসলাম নয়ন বলেন, “যদি ক্যাম্পাস স্থানান্তরিত হয়, তাহলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানাব।

“আমাদের অবশ্যই বড় ক্যাম্পাস দরকার। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবসময় চায় ঐতিহ্যটা যেন রক্ষা হয়। এটা তো টাকার বিনিময়ে পাব না।”

ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ব্রাহ্ম ধমের্র মূল মতবাদ সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের জানানোর জন্য আরমানিটোলায় ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব প্রাঙ্গণে ১৮৫৮ সালে চালু হয় অবৈতনিক ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল।

আর্থিক সঙ্কটের কারণে ১৮৭২ সালে মালিকানা পরিবর্তন করে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয় বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে। জমিদারের বাবার নামে এর নতুন নাম হয় ‘জগন্নাথ স্কুল’।

এরপর ১৮৮৪ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। ১৮৮৭ সালে ‘কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল’ নামে স্কুল শাখাকে জগন্নাথ কলেজ থেকে আলাদা করা হয়, যা এখন কে এল জুবিলি স্কুল নামে পরিচিত।

১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাস করে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ কলেজে স্নাতক শিক্ষা বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত শিক্ষা সীমিত করা হয়।

১৯৪২ সালে মেয়েরাও জগন্নাথ কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়। পরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ দিতে জগন্নাথ কলেজে প্রথম নৈশকালীন পাঠদান শুরু হয়।

১৯৬৮ সালে জগন্নাথকে সরকারি (প্রাদেশীকীকরণ) করা হয়, ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফায় এর বিরোধিতা করলে ওই বছরই কলেজটি আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।

২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশের মাধ্যমে জগন্নাথ কলেজ ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’-এ উন্নীত হয়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ২৭/৪ ধারাও (নিজস্ব আয় বাড়ানো) বাতিল করে সরকার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক শিক্ষার্থী, কর্মকর্তারাও ক্যাম্পাস স্থানান্তরের বিপক্ষে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সদস্য আবদুস সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ক্যাম্পাস হিসেবে এই জায়গাটার কথাই বলা আছে। আমরা চাই জায়গাটা থাকবে এবং কেরানীগঞ্জে যেটা হবে সেটা হবে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। সকল শিক্ষকরাই এটা চায়, কোনোভাবেই স্থানান্তর চায় না। শুধু শিক্ষকরা না, শিক্ষার্থীদেরও একই দাবি।”

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় এখানে থাকুক, আর কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাস হোক। এই জায়গাটা আমাদের আবেগের, সেন্টিমেন্টের; তাই ছাড়তে চাই না। এখানে যেহেতু আমরা শুরু করেছি, এখানে একটা অংশ থাকুক; তাহলে ভালো লাগবে।”

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রফ্রন্টের সাবেক সভাপতি কিশোর কুমার সরকার বলেন, “বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাস আছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বাংলাদেশের না, উপমহাদেশের একটা ঐতিহ্য। ১৬১ বছরে এখানে অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিরা পড়েছেন, পড়িয়েছেন।

“জায়গাটাকে অন্য কোনো জায়গায় দেওয়া হলে শুধু বর্তমানরা না, প্রাক্তণরাও প্রতিবাদ করবে। কারণ এ ক্যাম্পাসের সাথে শিক্ষার্থীদের নাড়ির সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে শুধু কিছু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া আমরা মানব না।”

বর্তমান ক্যাম্পাসে কোনো ফ্যাকাল্টি বা ইন্সটিটিউট রেখে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নুল আবেদীন রাসেল।

বিজ্ঞান অনুষদ ভবন

বলেন, “এ স্থানটা যত ছোটই হোক না এটা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গর্ব করার জায়গা। আমরা এর স্থানান্তরের তীব্র বিরোধী। এখান থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস মুছতে দেওয়া যাবে না। আমরা তা করতে দেব না।”

তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে উপাচার্য মীজানুর রহমানের।

তিনি বলেন, “ইতিহাসের সাথে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। জগন্নাথ কলেজের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের কোনো সম্পর্ক নেই, কয়েকটা পুরাতন বিল্ডিং ছাড়া। এখানে সবকিছুই নতুন; ঐতিহ্য বলতে যা বোঝায় নামটা শুধু, সেটা তো আছেই।

“যখন নতুন ক্যাম্পাস হবে তখন সিদ্ধান্ত হবে বিশ্ববিদ্যালয় এখানে থাকবে কি থাকবে না। দুই জায়গায় কখনও বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় দুই জায়গায় হলে সমস্যা আছে। এটা যেহেতু একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, পরবর্তীতে হয়তো একাডেমিক কাজেই ব্যবহার হবে।”