ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্রিয়াশীল’ ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার পর সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
উপাচার্য বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের কাজের যে লোড, যে কর্মপরিধি তা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের প্রভোস্ট কমিটি, শৃঙ্খলা পরিষদ ও সিন্ডিকেট একটা লক্ষ্য ইতোমধ্যে দিয়েছে, সেটা হল মার্চ ২০১৯। এই নিরিখে আমাদের ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। আশা করি অক্টোবরের মধ্যে খসড়া ভোটার তালিকা হয়ে যাবে। এই ভোটার তালিকা প্রণয়ন একটি জটিল কাজ। সেটি করতে পারলে অনেক এগিয়ে যাব।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মার্চ মাসের লক্ষ্যের কথা বললেও ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে সবচেয়ে সোচ্চার অবস্থানে থাকা বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়েছে।
অন্যদিকে ক্যাম্পাসের হলগুলোর কর্তৃত্বে থাকা ছাত্রলীগ এবং ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ছাত্রদলের কাছ থেকে এসেছে একই রকম বক্তব্য। দুই দলই বলেছে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন করার কথা। তবে ছাত্রদলের দাবি, নির্বাচনে যাওয়ার আগে ক্যাম্পাসে সব সংগঠনের সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
রোববার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয় সংলগ্ন আব্দুল মতিন ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষে প্রায় চার ঘণ্টা এই বৈঠক চলে।
ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি ও শিক্ষক সমিতি নেতারা সভায় বক্তব্য দেন।
আলোচনা শেষে উপাচার্য লাউঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক কবি মুহম্মদ সামাদ, প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, “আলোচনাকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। কবে নাগাদ ডাকসু ইলেকশন দেওয়া যায়, ক্যাম্পাসে সহাবস্থান, সম্ভাব্য তারিখ- এসব বিষয় নিয়ে ছাত্ররা আলোচনা করেছে।
"শিক্ষার্থীদের সাথে যে আলোচনা হয়েছে, এটা নিয়ে প্রভোস্ট কমিটির সাথে আমরা বসে পর্যালোচনা করব। শিক্ষার্থীদের সাথে এটা আমাদের প্রাথমিক আলোচনা, আমরা পরবর্তীতে আরও বসব।”
নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সব দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করার যে দাবি এসেছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উপাচার্য বলেন, “প্রভোস্টবৃন্দ এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। মধুর ক্যান্টিনকেন্দ্রিক যে রাজনৈতিক চর্চা, সেটি সকলের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের যে কার্যক্রম চালাবে তাতে প্রশাসন থেকে কোনো বাধা নেই।”
ছাত্রলীগের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের দৃশ্যমাণ কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে ডাকসু নিয়ে আলোচনার দিনে দুই দলের নেতাদের দেখা গেল শান্তি শান্তি ভাব।
সভা শেষে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক বাশার সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে উপাচার্যের কার্যালয় থেকে বের হন।
ছাত্রলীগ নেতা রাব্বানীকে এ সময় ছাত্রদল সভাপতি রাজিবের ঘাড়ে হাত রেখে হাসিমুখে এগোতে দেখা যায়। পরে রাব্বানী ও রাজিব একসঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “ডাকসু নির্বাচনটা যেন যৌক্তিক সময়ে হয়, সে দাবি আমাদের থাকবে। অনেকে এ বছরের নভেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছে। আমরা বলেছি, আমরা কোনো সময় বেঁধে দেব না। কারণ এটি নির্দিষ্ট করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যখন করতে চায়, তখনই আমরা নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছি।”
জবাবে রাব্বানী বলেন, “প্রত্যেকটি হলে ছাত্রলীগের সংখ্যা ৩০ শতাংশ। এর বাইরে যারা আছে, তারা কিন্তু বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মী এবং সাধারণ ছাত্র। ক্যাম্পাসে সহাবস্থান অবশ্যই প্রয়োজন, তবে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র, শুধু তারাই ক্যাম্পাসে আসতে পারবে। যারা নিয়মিত ছাত্র নয় এবং যারা ক্যাম্পাসের শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটাতে চাইবে তারা ক্যাম্পাসে থাকার কোনো অধিকার রাখে না।”
বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান বলেন, “আমাদের একটি দাবি ছিল, নির্বাচনের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সকল দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে; ডাকসু নির্বাচনের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকল দলের জন্য রাজনীতি করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”
ছাত্রলীগের রাব্বানীর মত ছাত্রদলের রাজিবও ‘একটি যৌক্তিক’ সময়ে ডাকসু নির্বাচন করার কথা বলেন।
“তার আগে ডাকসুর কার্যক্রমগুলো চালু করতে হবে। আমরা আবারও বলছি, যদি ক্যাম্পাসে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়, কেবল তাহলেই ডাকসু নির্বাচন করা যাবে বলে আমরা আশা করছি।”
রাজিব আহসানের কথা শেষ হলে প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ছাত্রদলের দুই নেতাকে গাড়িতে তুলে দেন।
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ও তফসিল ঘোষণার কথা আমরা সভায় বলেছি। এর আগে সকল রাজনৈতিক দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
“আমরা বলেছি, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়।… স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলনের সময় ডাকসু নির্বাচন হতে পারলে এখন কেন তা সম্ভব নয়?”
এর আগে ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে পরে নির্বাচন আটকে যাওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে লিটন বলেন, “প্রশাসনের কাছে দাবি রেখেছি, যাতে এবার সেরকম কিছু না হয়। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে সুস্পষ্ট তারিখ চেয়েছি।"
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একাংশের সভাপতি ইমরান হাবীব রুমন বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, আগামী অক্টোবরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করে নভেম্বরের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া উচিত। জাতীয় নির্বাচনের মারপ্যাঁচে আগের মত এবারও উদ্যোগটা যেন ঝিমিয়ে না পড়ে। আমরা মনে করি ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচনটা হোক।"
স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
প্রতিবছর ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভোট হয়েছে মাত্র ছয়বার। সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচনের পর বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সে নির্বাচন আর হয়নি।
ছয় বছর আগের একটি রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি এক রায়ে হাই কোর্ট ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়।
কিন্তু সাত মাসেও নির্বাচনের কোনো আয়োজন দৃশ্যমাণ না হওয়ায় গত ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিস পাঠান রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
তার জবাব না পেয়ে গত বুধবার তিনি হাই কোর্টে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন উপাচার্যসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।