ব্যাংকের টাকা বহনের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কোম্পানিটির কর্মীদের ভাষ্যে সন্দেহ হচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তাদের।
Published : 09 Mar 2023, 09:51 PM
ঢাকার উত্তরায় গাড়ি থেকে যারা ডাচ বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা লুট করেছিল, তাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। আর যে নিরাপত্তা কোম্পানিটি টাকা পরিহনের দায়িত্বে ছিল, তাদের কর্মীদের কাছেও ছিল না কোনো অস্ত্র।
পুলিশের ভাষ্য, টাকা পরিবহনের জন্য বিশেষভাবে ‘মডিফাইড’ মাইক্রোবাসে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের খালি হাতেই কুপোকাত করেছিল ছিনতাইকারীরা।
এই লুটকাণ্ডের পর কিছু টাকা উদ্ধারের পাশাপাশি বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ, যার মধ্যে টাকা পরিবহনে নিয়োজিত কোম্পানির কয়েকজনও রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৭টার দিকে উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সেতু এলাকায় টাকার ট্রাংকভরতি ওই মাইক্রোবাস ছিনতাই হয় বলে জানিয়েছিলেন পুলিশের উত্তরা জোনের সহকারী কমিশনার রাইসুল ইসলাম।
ওই গাড়িতে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথে ভরার জন্য ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিল বলে পুলিশকে জানানো হয়েছিল।
মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি বার্ষিক চুক্তিতে ডাচ বাংলা ব্যাংকের নির্ধারিত বুথে টাকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে আছে। কোম্পানটি গ্রিল ঘেরা একটি টয়োটা নোয়া মাইক্রোবাসে টাকা পরিবহন করছিল।
ছিনতাইকারীরা ভাড়ায় আনা একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস দিয়ে সেটির গতিরোধ করে। এরপর নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর করে নামিয়ে দিয়ে মানি প্ল্যান্টের গাড়িটি ছিনতাইকারীরা নিয়ে চলে যায় বলে হামলার শিকার ব্যক্তিরা পুলিশকে জানিয়েছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মানি প্ল্যান্টের কার্যালয় মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায়। সকালে তারা দিয়াবাড়ী দিয়ে উত্তরা হয়ে টঙ্গী যাচ্ছিল। সোয়া ৭টার দিকে মানি প্ল্যান্টের মাইক্রোবাসটিকে হাইয়েস মাইক্রোবাস দিয়ে আটকে দেয় ছিনতাইকারীরা। তারা সংখ্যায় ১০-১২ জনের মতো ছিল বলে মানি প্ল্যান্টের কর্মীদের ভাষ্য।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, মানি প্ল্যান্টের গাড়িটিতে চালকসহ ছিলেন পাঁচজন। ছিনতাইকারীরা পথরোধের পর মানি প্ল্যান্টের নোয়া মাইক্রোবাসটির এক পাশের দরজা ভেঙে ফেলে নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর শুরু করে। তারা গাড়ির চালক ও তিন নিরাপত্তাকর্মীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনে। মানি প্ল্যান্টের এক কর্মী গাড়ি থেকে নামতে অস্বীকৃতি জানালে তাকেসহ গাড়িটি চালিয়ে উত্তরা বর্ধিত প্রকল্পের দিকে চলে যায় ছিনতাইকারীরা।
নিরাপত্তা কোম্পানিটির কর্মীদের বরাতে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, উত্তরা এক্সটেনশনে গিয়ে তারা মানি প্ল্যান্টের কর্মীকে লাথি দিয়ে নামিয়ে দেয়, আর ৪টি টাকার ট্রাঙ্ক নিজেদের হাইয়েস গাড়িতে স্থানান্তর করে দিয়াবাড়ি মেট্রো স্টেশনের নিচ দিয়ে পালিয়ে যায়। কালো রঙের এই মাইক্রোবাসটি বুধবার তারা টঙ্গী থেকে ভাড়া করে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
ঘটনার পরপর থানা পুলিশ, ডিবি, পিবিআইসহ পুলিশের কয়েকটি ইউনিট বিভিন্ন সড়কে তল্লাশি শুরু করে। এরপর বিকাল ৫টার দিকে খিলক্ষেত এলাকা থেকে কালো হাইয়েস মাইক্রোবাসটিসহ ৩টি টাকার ট্রাঙ্ক উদ্ধার করা হয়।
তবে ঘটনার এ বর্ণনায় সন্দেহ পোষণ করছেন পুলিশের কেউ কেউ।
ডাচ বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকাসহ গাড়ি ছিনতাই
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের লুট হওয়া টাকার ‘বেশিরভাগ’ উদ্ধার
ঘটনার সময় মানি প্ল্যান্টের কর্মীদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন পুলিশের উত্তরা জোনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
টাকা উদ্ধারের পর ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলের আশপাশের এলাকা থেকে আমরা লুট হওয়া বেশিরভাগ টাকা উদ্ধার করেছি। এখনও অভিযান চলছে।”
কত টাকা উদ্ধার হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “মোট ৪ ট্রাঙ্ক টাকা লুট হয়েছিল। এর মধ্যে ৩ ট্রাঙ্ক উদ্ধার হয়েছে। এখনও গোনা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ৯ কোটি টাকার মতো উদ্ধার হয়েছে।”
তবে টাকা পরিবহনের নিরাপত্তা কোম্পানি মানি প্লান্ট লিংকের এমডি যশোদা জীবন দেবনাথ রাত পৌনে ১০টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উদ্ধার হওয়া ৩টি ট্রাঙ্কের মধ্যে একটি খালি ছিল। বাকি দুটিতে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার হয়েছে।”
ছিনতাইকারীদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না উল্লেখ করে ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ বলেন, “এই টাকা আনা-নেওয়ার বিষয়টি ছিনতাইকারীরা অনেক দিন ধরেই অনুসরণ করছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ছিনতাইকারীদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না।”
এ ঘটনায় মানি প্লান্টের দুজন পরিচালসহ সাতজনকে আটকের কথা জানান তিনি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
মানি প্লান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা বলেন, “আমাদের কোম্পানি প্রতিদিনই এটিএম বুথে টাকা লোড করে। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে সাভার ইপিজেডে যাচ্ছিল। উত্তরা দিয়াবাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস আমাদের টাকার গাড়ির সামনে এসে পথ আটকে দেয়।
“এরপর ওই মাইক্রো থেকে ৪/৫জন লোক বের হয়ে আমাদের ড্রাইভারসহ সিকিউরিটি গার্ডকে মারধর করে চাবি কেড়ে নেয় এবং গাড়ি থেকে লোকজনকে ফেলে দেয়। এরপর তাদের একজন আমাদের গাড়িটা ড্রাইভ করে চলে যায়।”
একে ‘ডাকাতি’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের গাড়ি নিয়ে কিছু দূর গিয়ে তারা দেখে তখনও আমাদের একজন লোক গাড়িতে ছিল। এরপর গাড়ি থামিয়ে তাকে মারধর করে ফেলে দেয়। এরপর চারটা (টাকার) ট্রাঙ্ক নিয়ে ‘ডাকাতরা’ তাদের গাড়িতে উঠে চলে যায়।”
এরপর তুরাগ থানায় গিয়ে পুলিশকে অবহিত করলে তৎপরতা শুরু হয় বলে জানান যশোদা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সারাদিন আমরা ডাচ বাংলা ব্যাংকের বিভিন্ন বুথ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ওই টাকা আবার ছেঁড়া-ফাটা বাছাই করে ভালো টাকাগুলো আবার লোড করি। এটাই আমাদের সার্ভিস।”
আপনাদের গাড়িতে কি অস্ত্র ছিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে যশোদা বলেন, “ওই গাড়িতে গানম্যান ছিল না। ৩টা গাড়ি আসতেছিল। মাঝের গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। তখন গানম্যানসহ ২টা গাড়ি পেছনে পড়ে যায়। ওই (ছিনতাইয়ের শিকার) গাড়িটা আগে চলে আসে, তারপরই এই ঘটনাটা ঘটে যায়।”
শেষের গাড়িতে দুইজন গানম্যান ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডাকাতদলের কাছে অস্ত্র ছিল কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মানি প্লান্ট লিংকের এমডি যশোদা বলেন, “ডাকাত দলের কাছে অস্ত্র ছিল- এইরকম ইনফরমেশন আমি পাইনি।“