এফবিসিসিআই সভাপতি বলছেন, যে যুক্তিই দেখানো হোক, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম এত বাড়ার ‘কোনো কারণ নেই।’
Published : 23 Mar 2023, 09:15 PM
সরকার নির্ধারিত দরে প্রতি কেজি ১০২ টাকায় মিল গেট থেকে না পাওয়ায় চিনির দাম খুচরা পর্যায়ে ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে বলে এক মত বিনিময় সভায় জানালেন চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মফিজুল হক।
তিনি বলছেন, “আমরা যে দামে চিনি পাব, তার সঙ্গে পরিবহন খরচ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২ টাকা যোগ করে দোকানদারদের দিতে পারব। কিন্তু আমরা ১০২ টাকার পরিবর্তে চিনি পাচ্ছি ১০৫-১০৭ টাকায়। তাহলে কেমনে কম দামে চিনি দেব? খুচরা পর্যায়ে তো দাম বাড়বে।”
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই রমজানের পণ্যর সরবরাহ, মজুদ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে এই মতবিনিময় সভায় অংশ নেন।
চিনির দাম নিয়ে মফিজুল হকের বক্তব্যের পর এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, “চিনিতে ৬২ শতাংশ কর ছিল। সরকার পরে ৫ শতাংশ কমিয়েছে। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব তেমন একটা নেই।সরকার চাইলে আরো সমন্বয় করতে পারে।
“এখন ৩ লাখ মেট্রিক টনের বেশি চিনি রয়েছে। ভোজ্যতেলও চাহিদার তুলনায় বেশি মজুদ আছে। খেজুর এখন সবখানেই পাওয়া যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতির কোনো শঙ্কা নেই।”
চিনি ব্যবসায়ী মফিজুল হক এ সময় অভিযোগ করেন, “মিলগেট থেকে কোনো ভাউচার (রশিদ) দেওয়া হয় না। আমরা তাই দেখাতেও পারি না।”
আড়ত ও মিলগেটে পণ্য কেনা-বেচার ক্ষেত্রে রশিদ বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি বাস্তবায়নে এফবিসিসিআই সরকারের সাথে কাজ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন জসিম উদ্দিন।
বাংলাদেশ শুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ২৬ জানুয়ারি চিনির দাম ঠিক করে বাণিজ্য সচিবের কাছে চিঠি দেয়।
তাতে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম চার টাকা বাড়িয়ে ১১২ টাকা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়।
অবশ্য এই দামে কোথাও চিনি পাওয়া যায় না। রাজধানীর হাতিরপুল বাজারে বৃহস্পতিবার খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি খোলা চিনি বিক্রি হয় ১২০ টাকায়। কখনও কখনও বেশি দামেও চিনি মেলে না দোকানে, যদিও মজুদ বা সরবরাহে কোনো সংকট নেই বলে সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়ে আসছে।
এফবিসিসিআইয়ের এই মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন চিনি পরিশোধনের অন্যতম বড় কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা। তিনিও বলেন, রোজার জন্য চিনির মজুত যথেষ্ট আছে। তবে মিল গেটে বেশি দাম রাখা বা ভাউচার না দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি।
পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলে বিশ্বজিৎ সাহা দাবি করেন, “আমরা মিল গেটে নির্ধরিত দামেই চিনি বিক্রি করছি।”
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গত রোববার বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক সভায় চিনির দাম রোজায় কমতে পারে বলে আভাস দিয়েছিলেন। তবে সেই ঘোষণা এখনও আসেনি।
রোজায় কমতে পারে চিনির দাম, সয়াবিনে ‘সুযোগ নেই’: বাণিজ্যমন্ত্রী
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেলের লিখিত পরামর্শে বলা হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় গতবারের তুলনায় এবার রোজায় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম থাকবে।
দেশে বছরে ২০ লাখ টন চিনির চাহিদার বিপরীতে আখ থেকে আসে ৩০ হাজার টন। প্রতি বছর ২০ লাখ থেকে ২২ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়। সেখান থেকে পরিশোধনের সময় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ‘সিস্টেম লস’ দেখানো হয়।
চিনি আমদানিতে প্রতি টনে ৩ হাজার টাকা সিডি, ৩০ শতাংশ আরডি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৪ শতাংশ এটি রয়েছে। সব মিলিয়ে চিনিতে ৬১ শতাংশ শুল্ক ছিল। সরকার সেখান থেকে সিডি শূন্য ও আরডি ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ার ‘যুক্তি নেই’
ভুট্টা সরবরাহকারী সংগঠনের সভাপতি রবিউল ইসলাম মত বিনিময়ে বলেন, পোল্ট্রি ফিড তৈরির ৬০ শতাংশ কাঁচামালই ভুট্টা, এই ভুট্টার ৮০ শতাংশই দেশীয়। মাত্র ২০ শতাংশ আমদানি করা হয়।
প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ৪২ টাকা থেকে এখন ৩৬ টাকায় নেমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মুরগির দাম এত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ নেই।”
তার কথা সমথর্ন করে পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহৃত ওষুধ ও রাসায়নিকের সরবরাহকারী বায়ো ফার্মার প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম খান বলেন, রাসায়নিকের যে দাম বেড়েছে, তাতেও মুরগির এত দাম বাড়ার কথা নয়।
মুরগি ও গরুর মাংসের দর বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জসিম উদ্দিন বলেন, “ডলারের দাম বাড়ার যুক্তিসহ যেই যুক্তিই দেখানো হোক, এত দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো কারণ নেই। হঠাৎ করেই দাম বেড়েছে।’’
“এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকার মাংস ও ডিম আমদানির চিন্তাও করতে পারে। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তাহলে বলতে পারি ওপেন (অনুমোদন দিতে) করে দিতে। তাহলে পোল্ট্রি শিল্পের কী হবে?” প্রশ্ন করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
তিনি বলেন, “এফবিসিসিআই অভ্যন্তরীণ শিল্পকে নিরাপত্তা দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু নিরাপত্তার নামে এভাবে মুনাফা করলে তো মানুষের কষ্ট হবে। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই, ব্যবসায়ীদের সেটা বুঝতে হবে।”
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ব্রয়লার মুরগি এখন ২৮০ টাকা। দুবাইয়ে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫০০ টাকা। কিন্তু দুবাইয়ে গরু উৎপাদন হয় না। তারা আমদানি করে যদি ৫০০ টাকা দিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের মানুষ উৎপাদন করে কেন এত দামে (৭৫০ টাকা) কিনবে?
পণ্যর দাম নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ মন্ত্যব্য করে তিনি বলেন, “দাম বাড়ালে মোবাইল কোর্ট চলবে। ধর-পাকড় করলে তো দাম কমে।”
এফবিবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় পোল্টি খাতের উদ্যোক্তাদের অংশ নিতে চিঠি দেওয়া হলেও তারা আসেননি বলেন জানান জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সবাই ব্যবসায়ীদের দিকেই আঙ্গুল তুলছে।
সরবরাহে ‘সমস্যা নেই’ ভোজ্য তেলে
ভোজ্যতেল উৎপাদরকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অয়েল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, “তেলের যথেষ্ট মজুত আছে। রমজানে কারখানা পর্যায়ে গ্যাস ঠিক থাকলে এসব পণ্যের সরবরাহে কোনো ঘাটতি হবে না।”
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভোজ্যতেলের (সয়াবিন, পাম ও সরিষা) বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন, স্থানীয় উৎপাদন ২ লাখ ৩ হাজার টন। বছরে ২০ লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম তেল আমদানি করা হয়। এই খাতে কয়েক ধাপে শুল্ক প্রত্যাহারের পর বর্তমানে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত আছে।
প্রতি মাসে এক লাখ ৪০ হাজার টন থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টন ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকলেও রোজায় তা দ্বিগুণ বেড়ে তিন লাখ টনের চাহিদা তৈরি হয়।
সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, আদানি গ্রুপের বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও বসুন্ধরা গ্রুপ মিলিয়ে ভোজ্যতেলের মুজদ রয়েছে ৩ লাখ দুই হাজার ১৬৩ টন, পাইপলাইনে আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৮৪৫ টন।
এফবিসিসিআই এর সহ-সভাপতি এম এম মোমেন, দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা মত বিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন।