‘ব্যবসার পরিস্থিতি খারাপ’, বলছেন ফুটপাতের দোকানিরা

বিক্রেতাদের ভাষ্য, জীবন-যাত্রার ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাওয়া মানুষ এবার ঈদে কেনাকাটায় অনাগ্রহী।

ফয়সাল আতিকমরিয়ম সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2023, 04:05 PM
Updated : 19 April 2023, 04:05 PM

ঈদের আগে বঙ্গবাজারের পর নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঢাকার ফুটপাতের কেনা-বেচায় প্রভাব ফেলার কথা। ওই দুই এলাকায় দোকানিদের ঈদের বিকিকিনি কমার কথা থাকলেও বাড়ার আশায় ছিলেন অন্য এলাকার ফুটপাতের দোকানিরা।

কিন্তু তেমনটা ঘটেনি বলেই জানালেন ওই সব ফুটপাতের দোকানিরা। ফার্মগেইটের ফুটপাতের জুতা বিক্রেতা বাদশা মিয়ার ভাষায়, ব্যবসার পরিস্থিতি ‘খুবই খারাপ’।

কেন খারাপ- সেই প্রশ্নে বিক্রেতাদের ভাষ্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ জীবন-যাত্রার ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাওয়া মানুষ এবার ঈদের কেনাকাটায় অনাগ্রহী।

ফুটপাতের এই সব দোকানে বরাবরই নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড় জমে। এবার যেসব ক্রেতা পাওয়া গেল, তারা বলছেন, সব পণ্যেরই দাম বেশি।

রোজার ঈদের তিন দিন আগে বুধবার ঢাকার মিরপুর, ফার্মগেইট, নিউ মার্কেট এলাকার ফুটপাথ ঘুরে অন্য সময়ের মতো ভিড় দেখা যায়নি।

মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে মেয়েদের পোশাক বিক্রি করছিলেন কাউসার আহমেদ।

ঈদ বাজারের পরিস্থিতি জানতে চাইলে দীর্ঘ এক বক্তব্য দেন এই যুবক । অন্য সময় বিক্রেতাদের কথা বলার ফুরসতও থাকত না।

কাউসার বলেন, “আমরা ব্যবসায়ীরা ভালো নাই। আমরা ১২ মাস ধরে যেমন বিক্রি করি, এখন ঈদের সময়ও তেমন বিক্রি করতেছি।”

কয়েকটি মার্কেটে আগুন লাগার পর অন্য ফুটপাতে তো বিক্রি বাড়ার কথা- এমনটা বলা হলে তিনি বলেন, “মার্কেটে আগুন লাগছে, কিন্তু মানুষের মনে তো আগুন লাইগা আছে। মানুষ যদি টাকাই কামাই করতে না পারে, তাহলে কিনব কেমনে? কারও কাছে তেমন টাকা নাই।”

যারা কিনতে আসেন, তারাও বেশি খরচ করতে চাইছেন না জানিয়ে কাউসার বলেন, “এখন যারা আসেও তারা কেনা দামের চেয়ে অনেক কম দাম হাঁকায়। আমরা একটা প্রোডাক্টে ৩০ টাকা লাভ করতে চাই। কিন্তু এর চেয়েও কম দাম বলে। একটা মালের দাম ৩০০ টাকা, কিন্তু মানুষ দাম হাঁকায় দেড়শ টাকা। এই মানুষগুলাই গত বছর বা তার আগের বছর আরও কম মুলামুলি করে জিনিস কিনে নিয়ে গেছে।”

এক দিন আগে এক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “গতকাল একজন মহিলা মাল কিনতে এসে মুলামুলি করতে গিয়ে পুরা কান্না করে দিছে। ৩০০ টাকা একটা প্রোডাক্টের দাম, কিন্তু তার কাছে টাকা নাই। তার ওই জামা লাগবেই। কত টাকায় সে প্রোডাক্টটা কিনবে, সে দামও বলার সাহস করতেছে না। সে এক পর্যায়ে কাইন্দা দিছে। পরে সে প্রোডাক্টটা আমি কি না দাম আড়াইশ টাকায় দিয়া দিছি।”

সেনপাড়া পর্বতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে কৃত্রিম চামড়ার ব্যাগ ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সৈয়দ হোসেন বলেন, পুরান ঢাকা থেকে কিনে আনা এসব ব্যাগ গড়ে ৫০০ টাকা করে তারা বিক্রি করেন। গত বছরের চেয়ে এবার ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দামে ব্যাগ কিনতে হয়েছে তাদের।

“কিন্তু পাবলিকের কাছে বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তারা দাম বাড়াতেই চাচ্ছে না। ঈদ বাজারে এবার তেমন ভরপুর বেচাকেনা লাগে নাই। এবার বেচাকেনা খুবই কম। কাস্টমার কম। এবার মনে হয় কাস্টমার বিলাসিতা কম করতেছে।”

সেখানে ব্যাগ কিনতে আসা শেফালী রানী বলেন, “যেখানেই যাই, দামটা মনে হয় একটু বেশি বলছে।”

মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১ নম্বরের দিকে যেতে ফুটপাতের উপর ছেলে-মেয়ে, শিশু হতে শুরু করে সব বয়সী মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান রয়েছে। একই চিত্র রয়েছে ফার্মগেইট, নিউ মার্কেট, মৌচাক, মালিবাগ এলাকার ফুটপাতে।

মিরপুর ১০ নম্বরে শিশুদের জামা বিক্রেতা মোবারক হোসেন বলেন, “ইফতারের পর লোক বাড়লেও বেচাকেনা বাড়ে না। অন্যান্য বছর আরও ভালো বেচাকেনা হত।”

মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজের সামনের ফুটপাথে চীন থেকে আসা জুতার বিক্রেতা মোহাম্মদ সুমন বলেন, “বেচাকিনা আগের থিকা একটু কম। কাস্টমারের চাপ বাড়ে নাই। যা আছে আল্লার রহমতে টুকিটাকি চলতাছে।”

ফুটপাথে চীনের জুতাগুলো ২২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। ২০ দিন আগেও এসব জুতা ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

এই দোকানের সামনেই কয়েকজন নারী ক্রেতাকে দেখা যায় প্রতি জোড়া জুড়া দেড়শ টাকায় কেনার চেষ্টা করছেন। এই দোকান লাগোয়া বেশি কিছু অলংকারের দোকানে বেশ ভালো ক্রেতা দেখা গেছে।

ফার্মগেইটের ম্যাবসের গলির সামনেই ফুটপাতে মেয়েদের এবং বাচ্চাদের জুতা বিক্রি করছিলেন বাদশা মিয়া। কিশোরগঞ্জ থেকে ৪২ বছর আগে এসে জুতার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ঈদের আগমুহূর্তে ব্যবসার হাল দেখে বিষণ্ন মুখে বসেছিলেন তিনি।

বাদশা বলেন, “বুঝতেছি না। অন্যদিন যেমন বিক্রি হয়, আজকেও তাই হইতেছে। আলাদা কিছু না। অন্য সব বছর সবাই বাড়ি যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে এসে জুতা কিনে। কিন্তু এবার কেন যেন কেউ কিছু কিনতেছে না।”

ফার্মগেইটের ফুটপাতে জুতার দোকানি মো. রহিম বলেন, “কই ব্যবসা? ব্যবসাই তো দেখতেছি না। সকাল থেকে খালি ঝাড়তেছি মুছতেছি, তেমন কোনো কাস্টমার নাই।

“এই দুই-একজন কাস্টমার আয়-যায়। কিন্তু এইটাকে তো আর ঈদের বাজার বলা যায় না। এবার আমাদের ব্যবসার অবস্থা একবারেই ভালো না।”

ফার্মগেইটের পুরো ফুটপাত জুড়ে ছেলেদের, মেয়েদের, বাচ্চাদের জামা আর জুতোর দোকানে ভর্তি।

তেমনই এক দোকানে গত ৫ মাস ধরে কাজ করছেন মিনহাজুর। তিনি বলেন, “আমরা তো শুধু গেঞ্জি বেচি। আগেও যেমন বেচতাম, এখনও প্রায় তেমনই।”

তবে বাচ্চাদের জামাকাপড় ও টুপি-পাঞ্জাবির দোকানে ভিড় কিছুটা বেশি দেখা গেছে।

ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনের ফুটপাতে ছোট এক দোকানে শিশুদের জামা-কাপড় বিক্রি করেন আরিফ।

তিনি বলেন, “ঈদে বাপ-মা কিছু না নিলেও পোলাপানের জন্য তো না কিইনা পারে না। সেই জন্যই আল্লাহর রহমতে আমাদের বেচাবিক্রি টুকটাক আছে। কিন্তু তাও আগের মতো না।”

এদিকে টুপি বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, “বিক্রি হইতেছে না, এমন না। হইতেছে। তয়, একটু কম। টুপি, পাঞ্জাবি এগুলা তো সারাবছর ওইভাবে বেচতে পারি না আমরা। তাই বিক্রির আশায় বছরের এই একটা দিনের দিকে চাইয়া থাকি। কিন্তু কাস্টমার ভিড়তেছে না আগের মতো আর।”

ক্রেতা না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মানুষের খরচ বাড়ছে। ইনকাম বাড়ে নাই। ঈদে তাইলে তারা নতুন জামা-কাপড় কিনবো কী দিয়া?”