“দেশের শীর্ষ দুই এনটিটিএন অপারেটর ‘যক্ষের ধনের মতো’ ফাইবার আগলে রেখে ডেটার মার্কেট ব্লক করে রেখেছে।সরকার এই নীতি ভাঙবে।”
Published : 09 Mar 2025, 06:44 PM
মোবাইল অপারেটরদের ‘ডার্ক ফাইবার’ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
তিনি বলেছেন, “মোবাইল অপারেটরদের আমরা এনটিটিএন প্রশ্নে অনেক ছাড় দেব। দেশের শীর্ষ দুই এনটিটিএন অপারেটর ‘যক্ষের ধনের মতো’ ফাইবার আগলে রেখে ডেটার মার্কেট ব্লক করে রেখেছে।সরকার এই নীতি ভাঙবে।
“সরকার চায় এনটিটিএনগুলো ডার্ক ফাইবার ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করুক, ব্যান্ডউইডথ বিক্রি করে নয়। দেশের অব্যবহৃত ফাইবার কেবলের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য পলিসি করা সরকারের পলিটিক্যাল প্রমিজ।”
রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রায় ৪১ মিনিটের বক্তৃতায় এসব কথা বলেন ফয়েজ আহমদ। এসময় তার পাশে বসে এই সরকারের কাজে সমর্থন জানানোর কথা বলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির বিশেষ সহকারী ইশরাক হোসেন।
‘প্রান্তিক পর্যায়ে দ্রুতগতির মানসম্পন্ন সহজলভ্য ইন্টারনেট প্রাপ্তিতে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ মোবাইল গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শীর্ষ তিনটি মোবাইল অপারেটর, দুটো শীর্ষ এনটিটিএন কোম্পানি, আইএসপি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ নেতারা, বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তিখাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বেসিস এর সাবেক ও বর্তমান নেতারা, মোবাইল টাওয়ার কোম্পানির প্রতিনিধি, ফ্রি ল্যান্সারদের প্রতিনিধি, আইআইজি খাতেরর ব্যবসায়ী নেতারা সহ এই খাতের প্রায় সব অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ব্যান্ডউইথ পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ফাইবার অপটিক কেবল। দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে দেশের মোবাইল অপারেটর ও এনটিটিএন অপারেটরগুলো।
২০০৯ সালের আগে মোবাইল অপারেটরগুলো নিজেরাই ফাইবার অপটিক্যাল কেবল লাইন স্থাপন করেছে, কেউ রেলের ফাইবার অপটিক্যাল কেবল লাইন ব্যবহার করেছে।
এরপরে আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তে ফাইবার কেবল স্থাপনের জন্য এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া হয়। এনটিটিএন লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী, শুধুমাত্র এই লাইসেন্সিরাই ফাইবার অপটিক বসাতে পারবে। তখন থেকেই ফাইবার কেবলগুলোর নিয়ন্ত্রণ পায় এনটিটিএন কোম্পানিগুলো।
এখন দেশে সরকারি তিনটি ও বেসরকারি তিনটি এনটিটিএন রয়েছে। তবে বাজারে বেসরকারি ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ এবং ‘সামিট কমিউনিকেশন্স’এর আধিপত্য রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার এ দুটো কোম্পানিকে ‘অনৈতিকভাবে’ বাড়তি সুযোগ দিয়েছে, শত কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এনটিটিএন কোম্পানিগুলো সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
ডার্ক ফাইবার হচ্ছে অব্যবহৃত ফাইবার। এটি এনটিটিএন বা নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটির ব্যবসায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এনটিটিএন কোম্পানিগুলো দুইভাবে ব্যবসা করে থাকে। তারা তাদের স্থাপন করা ফাইবারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্যান্ডউইডথ অনুযায়ী টাকা নিতে পারে। অথবা নির্দিষ্ট মূল্যে অব্যবহৃত ফাইবার বা ডার্ক ফাইবার কোনো কোম্পানির কাছে ভাড়া দিতে পারে, যাতে তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী শেষ প্রান্তের কানেক্টিভিটি তৈরি করে ডেটা পরিবহন করতে পারে।
মোবাইল অপারেটরগুলো সেবার ক্ষেত্রে ত্রুটি ও উচ্চ মূল্যের জন্য এনটিটিএনগুলোকে দায়ী করে আসছে। আইএসপিগুলোও উচ্চমূল্যের সেবার জন্য এনটিটিএনগুলোকে দায়ী করে আসছে। এর মধ্যেই সরকারের তরফ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর ভাষ্য এল।
প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে ফয়েজ আহমদ বলেন, “মোবাইল অপারেটরদের আমরা এনটিটিএন প্রশ্নে অনেক ছাড় দেব। আমরা প্রমিজ করেছি তাদের ডার্ক ফাইবারের ব্যবস্থা করে দেব। এটার একটা মডেল হতে পারে বিসিসির যে ফাইবারটা সামিট ও ফাইবার অ্যাট হোমের সাথে আছে, সেটার মাত্র দুটো কেবল ব্যবহার হয়। বাকি কেবল ব্যবহার হয় না। বাকি কেবল আমরা লিজ দেওয়ার উদ্যোগ নেব, অন্যদের অফার করব।
“রেলওয়ের সর্বোচ্চ ১২টা কোর ব্যবহার হয়। বাকি ১২ থেকে ৩৬টা কোর ব্যবহার হয় না। সেই কোর কীভাবে ব্যবহার করা যাবে তার উদ্যোগ আমরা নেব। একই সাথে পিজিসিবির, অর্থাৎ অব্যবহৃত যে ফাইবারটা আছে সেটা নিয়ে সরকারের চারটা এজেন্সিকে দিয়ে একটা ফাইবার ব্যাংক তৈরি করার চেষ্টা করা হবে। এই ফাইবার ব্যাংকটা এমনভাবে কাজ করবে যে যার লাগবে সে তাকে ভাড়া দেবে।”
দুটো এনটিটিএন কোম্পানির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “সুতরাং আপনাদের যে মনোপলি বা ডুয়োপলিস্টিক অ্যাপ্রোচ, সেখান থেকে আপনারা সরে আসেন। ইউ লে মোর ফাইবার অ্যান্ড ডু মোর বিজনেস। এক্সিসটিং ফাইবারকে যক্ষের ধনের মত আগলে রেখে বাংলাদেশে ডেটার মার্কেটকে ব্লক করে রাখার যে পলিসিগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো সরকার ব্রেক করবে।
“একটা জিনিস হচ্ছে যে আমাদের যে অর্ধ লক্ষ কিলোমিটার ফাইবার (কেবল) আছে তার মধ্যে মাত্র পাঁচ থেকে দশ হাজার কিলোমিটার হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড । দিস ইজ আ শেইম। এই শেইম থেকে আমাদের বের হতে হবে। কারণ এই ফাইবারটা টেলকো গ্রেড ফাইবার না। এটা দিয়ে ফাইভ জি চালানো যাবে না। সুতরাং আমাকে কীভাবে টেলকো গ্রেড ফাইবারের বিস্তার ঘটাতে হবে সেটার জন্য পলিসি বানাতে হবে।”
এনটিটিএনগুলো শুধু ডার্ক ফাইবার ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করবে মন্তব্য করে ফয়েজ আহমদ বলেন, “একজন বলেছেন তার ফাইবারের ওপর ডিডব্লিউডিএম (ব্যান্ডউইডথ বাড়ানোর যন্ত্র) বসাতে দেওয়া হয়নি। এটা সত্য কথা, আমি পলিসিগুলো দেখেছি। ওগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এবং এই পলিসিগুলো অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রিভিউ করা হবে। অর্থাৎ এনটিটিএন কানেকশনের ওপর ব্যবসা করবে। ক্যাপাসিটির ওপর ব্যবসা করবে না। সেটা কী, আপনি এখন ব্যান্ডউইডথ বিক্রি করছেন আমরা চাই না যে আপনি এটা করেন। আমরা চাই আপনি ডার্ক ফাইবার ভাড়া দেবেন।”
ফয়েজ আহমেদের এই বক্তব্যের পর মিলনায়তনে উপস্থিত আইএসপি ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানিয়ে হাততালি দেন।
তিনি বলেন, “ডার্ক ফাইবার ভাড়া দিলে সেটার নতুন বাজার তৈরি হবে। আপনারা সেই বাজারটা আবিষ্কার করতে পারেননি। সেজন্য ভয় পাচ্ছেন যে আপনার আয় কমে যাবে। এই ভয়টা মিথ্যা। আমি প্রমাণ দিতে পারি যে বিসিসির ৪৮ কোরের ফাইবার, মাত্র দুই কোর ব্যবহার হচ্ছে। কেন? বাংলাদেশে কী ডেটার চাহিদা নেই?
“সীমান্তের ওপারে যান। ভারতে মাথাপিছু ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বাংলাদেশের ৭০ গুণ বেশি। তাহলে কে এই ইন্টারনেট মার্কেটটাকে ব্লক করে রাখল। এটা আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে বিজিসিবি, বিটিসিএল, রেলওয়ে বা বিসিসির যে ফাইবার আছে কেন এগুলো আন্ডার ইউটুলাইজড। এগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। এগুলোকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য আমরা পলিসি নেব, এবং যে কোন মূল্যেই নেব। এটা আমাদের পলিটিক্যাল প্রমিজ।”
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, “আপনারা আইএসপিরা অনেক দাবি করেছেন। আমরা নতুন টপোলজিতে যাব। তবে আমরা নিশ্চিত করব যে কেউ যেন কিকড আউট না হয়। কাউকে ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে না। টপোলজি চেইঞ্জ আমরা দ্রুতই করব। সেখানে আমরা এমন কিছু পলিসি করব যারা লোকালি বিনিয়োগ করছেন সেই বিনিয়োগের সঙ্গে আমরা কিছু লাইসেন্স অবলিগেশন (বাধ্যবাধকতা) নিয়ে আসব।
“অর্থাৎ আপনি যদি মোবাইল কোম্পানি হন, তাহলে আপনি নির্দিষ্ট সংখ্যার গ্রাম, স্কুল-কলেজ, হাইওয়ে, নৌপথ, রেলপথ কাভার করছেন কিনা তার একটা বাধ্যবাধকতা থাকবে। আইএসপিগুলোর ক্ষেত্রে আপনি যে পপটা বসাচ্ছেন সেখানে এসএনএমপি, ভিজিবিলিটি এনএমএস আছে কী না? যদি না থাকে তাহলে আপনি বাদ পড়বেন। অর্থাৎ আমরা অ্যাকোমোডেট করব বেইজড অন ক্যাপাসিটি। আপনি যদি যেনতেনভাবে কোয়ালিটি এনশিওর না করে ব্যবসা করতে থাকেন, তাহলে আপনি কিকড আউট হবেন।”
একই সাথে আইআইজি, আইটিসি ও সাবমেরিন কেবল কোম্পানিগুলোকেও নজরদারির আওতায় আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানে সেবার নাম করে যেনতেন করে কেউ যেন ব্যবসা করতে না পারে। আমি বলছি এটা আমাদের ডিজিটাল ইকোনমির ফাউন্ডেশন।”
সার্ভারগুলো ঢাকা থেকে ভারতে নিয়ে যাওয়ায় দেশের ইন্টারনেট সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে মন্তব্য করে ফয়েজ আহমদ বলেন, “আমরা এটা ব্রেক করবো। আমরা আইটিসির ওপরে ব্লকিং এনেছি। ধীরে ধীরে আরেকটু ব্লকিং আনব। আমরা খুব দ্রুতই সিমিইউ ৬ (তৃতীয় সাবমেরিন কেবল) এ যাব। হাইপার স্কেলের ব্যবসায়ীদের জন্য আমরা নতুন সুবিধা দেব।”