পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রিন ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় এ প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছে কোম্পানিটি।
Published : 14 Jul 2023, 09:23 AM
ইজিবাইক, টমটমের মত বিদ্যুৎচালিত থ্রি হুইলারে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির প্রসারে ‘স্মার্ট ব্যাটারি’ উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সেবাদাতা কোম্পানি সোলশেয়ার।
প্রচলিত লেড অ্যাসিড ব্যাটারির চেয়ে তিনগুণ দামি লিথিয়াম ব্যাটারি এতদিন প্রান্তিক মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। তবে এখন ক্ষুদ্র ঋণদাতা অনেক প্রতিষ্ঠান সহজ কিস্তিতে গ্রাহকদের হাতে এই ব্যাটারি পৌঁছে দিতে এগিয়ে আসছে।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশের সড়কে এখন ৩০ লাখের বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ি চলছে। দেশের ৭৫ শতাংশ নাগরিক দিনে অন্তত একবার এসব বাহনে চড়ছেন বলে জার্মানির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জিআইজেডের বরাতে জানাচ্ছে সোলশেয়ার।
এসব বাহনের শক্তিশালী মোটর ঘোরাতে চার থেকে পাঁচটি লেড অ্যাসিড ব্যাটারি যুক্ত থাকে, যার বাজার মূল্য অন্তত ৫০ হাজার টাকা এবং ওজন প্রায় দেড়শ কেজি। এসব ব্যাটারি রিচার্জ করতে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময়ের প্রয়োজন পড়ে, বিদ্যুৎ খরচ হয় অন্তত ১২ কিলোওয়াট। এক চার্জে চলতে পারে সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার, যদিও যাত্রীর সংখ্যা ও রাস্তার ভালোমন্দ অনুযায়ী এই মাইলেজ কমবেশি হতে পারে।
অন্যদিকে ৪৮ ভোল্টের একটি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির দাম এক লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে; ওজন হয় ৭০ কেজি, মাইলেজ থাকে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার। মাত্র ৬ ঘণ্টায় ৭ থেকে ৮ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে রিচার্জ হয়ে যায়। সাধারণ ব্যাটারি এক বছরের মধ্যে অকেজো হয়ে গেলেও লিথিয়াম ব্যাটারির আয়ুষ্কাল থাকে অন্তত ৫ বছর।
প্রচলিত ব্যাটারির চেয়ে তিনগুণ বেশি দামি এসব ব্যাটারি দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হলেও বেশি দামের কারণে কিনতে পারছিলেন না চালকরা। তবে এ প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে ঋণদাতা সংস্থা, গ্যারেজ মালিক ও প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক বছর আগে ত্রিপক্ষীয় একটি ব্যবসা মডেল হাজির করে প্রশংসিত হচ্ছে সোলশেয়ার।
‘স্মার্ট’ লিথিয়াম ব্যাটারি
বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং প্রান্তিক পর্যায়ে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন সেবাস্টিন গ্রোহ। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের কয়েকজনের সঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সোলশেয়ার কোম্পানি।
সেসময় তারা দেখতে পান, বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের (বর্তমানে ৬০ লাখ গ্রাহক রয়েছে) ৩০ শতাংশই অব্যবহৃত হিসাবে অপচয় হয়। অন্যদিকে বিদ্যুতের অভাবে অনেক দরিদ্রর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হয়, তেমনই নানান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে তারা পিছিয়ে পড়েন।
এ সমস্যার সমাধানে সোলশেয়ার প্রথমে সোলবক্স নামের একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, যা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। মাত্র দুই হাজার টাকার একটি প্রযুক্তির সাহায্যে একজনের অব্যবহৃত বিদ্যুৎ হিসাব করে অন্যজন ব্যবহার করার সুযোগ তৈরির ফলে দেশের চরাঞ্চলে অনেকেই সৌর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
আর ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের কাজে সোলশেয়ার হাত দেয় বছর খানেক আগে। ইতোমধ্যে সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, ঢাকা, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ২৩টি গ্যারেজ তাদের এই সেবার আওতায় এসেছে।
সোলশেয়ারের হেড অব প্রজেক্ট (ফান্ডরাইজিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন) সালমা ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০২১ সালে আমার ইলেক্ট্রিক ভেহিকেল বা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা নিয়ে গবেষণায় নেমে দেখি চার্জিং সিস্টেমটা খুবই বিক্ষিপ্ত। গ্যারেজগুলো ছিল অগোছালো।
“চালক কিংবা গাড়ির মালিকরা অনেক ক্ষেত্রে এলাকার সমিতিগুলো থেকে ঋণ নিয়ে লেড অ্যাসিড ব্যাটারিগুলো কিনে গাড়িতে বসায়। সোলার হোমসিস্টেমের জন্য তৈরি এসব ব্যাটারি গাড়িতে ৯ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত সচল থাকে। আর ব্যাটারি কিনতে গিয়ে যে ঋণ নেওয়া হয় তা পরিশোধ করতে হয় ছয় মাসের মধ্যে। এর জন্য তাদেরকে প্রায় ৩৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ইন্টারেস্ট বা সুদ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ তারা কোনো সঠিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় ছিল না।”
সালমা বলেন, লেড অ্যাসিড ব্যাটারির ক্ষেত্রে মিশুকে চারটি এবং ইজিবাইকে পাঁচটি ব্যাটারির প্রয়োজন হয়। একেকটি ব্যাটারির দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। মোট ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগতো ব্যাটারিতে।
“ব্যাটারির আয়ুষ্কাল কম হওয়ায় একবারের টাকা পরিশোধ করতে না করতেই আবার ব্যাটারি কেনার সময় এসে যাচ্ছে। অর্থাৎ গাড়ির মালিকরা একটা ক্রমাগত ঋণ চক্রের মধ্যেই রয়ে যাচ্ছে। আমাদের উদ্ভাবিত স্মার্ট লিথিয়াম ব্যাটারি সিস্টেম একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও কম সুদের ঋণ ব্যবস্থাপনার একটা সমাধান হাজির করেছে।”
নিজেদের উদ্ভাবনের বর্ণনা দিয়ে সোলশেয়ারের প্রোডাক্ট অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের পরিচালক ঈসা আবরার আহমেদ বলেন, “সোলশেয়ার এখানে একটা আইওটি চিপ বানিয়েছে, যেটা বাংলাদেশে পেটেন্ট করা। আমরা এই চিপকে উন্নত প্রযুক্তির লিথিয়াম ব্যাটারির সঙ্গে যুক্ত করে একটা স্মার্ট ব্যাটারি বানিয়ে দিয়েছি।
“এই ব্যাটারি একাধারে প্রচলিত ব্যাটারির তুলনায় সময় সাশ্রয়ী, ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। এই ব্যাটারি যে কোনো স্থান থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং গাড়ির গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যায়। কতক্ষণ ধরে এই ব্যাটারি সার্ভিস দিয়েছে, সেই ডেটাও সংরক্ষণ করা যায়। ফলে ইলেক্ট্রিক ভেহিকেলের ক্ষেত্রে তথ্যের সন্নিবেশনের মাধ্যমে একটা ট্রান্সফারেন্সি আমরা এনেছি।”
‘প্রয়োজন গ্রিন ফাইন্যান্সিং’
তবে এই ব্যাটারির দাম প্রচলিত ব্যাটারির চেয়ে তিনগুণ বেশি জানিয়ে সোলশেয়ারের প্রোডাক্ট অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের পরিচালক আবরার বলেন, “সেজন্য আমরা এইক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী এনজিওগুলোর সংযুক্তি ঘটিয়েছি যাতে, করে নিম্ন আয়ের মানুষ সহজ কিস্তিতে ব্যাটারিগুলো পেতে পারে।”
বর্তমানে বেশ কয়েকটি এনজিও সোলশেয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ধরনের ব্যাটারিতে লগ্নি করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এই চিপ সহজে ঋণের কিস্তি ফিরে আনার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করছে। কারণ, বিষয়গুলো এমনভাবে সেট করা যে, সময় মত কিস্তি পরিশোধ না করলে গাড়ি থেমে যাবে। আবার চিপগুলো ব্যাটারি থেকে খুলে ফেলতে চাইলে ওই ব্যাটারির কর্মক্ষমতা ৭০ শতাংশ কমে যাবে।
“মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস ব্যবহার করে টাকা পরিশোধ করলেই গাড়ি চলবে। সশরীরে অফিসে এসে কিস্তি পরিশোধের কোনো ঝামেলা নেই। সোলশেয়ার অ্যাপের মাধ্যমে একটি গাড়ির সব প্রয়োজনীয় তথ্য মালিকের অ্যাকাউন্টে সংরক্ষিত থাকছে যা, একই সঙ্গে ঋণদাতা এনজিও, মালিক, চালক ও সোলশেয়ার দেখতে পাচ্ছে।”
বর্তমানে দেশের ২৩টি স্থানে গ্যারেজ মালিক, এনজিও এবং সোলশেয়ার যৌথভাবে লিথিয়াম আয়নের ব্যাটারির এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জানিয়ে সোলশেয়ার কর্মকর্তা আবরার বলেন, “পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রিন ফাইন্যান্সিংয়ের আওতায় এই প্রকল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তাহলে এ ধরনের পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রসার আরও দ্রুত হবে।
“বর্তমানে এনজিওগুলো ৯ শতাংশ সুদহারে টাকা নিয়ে ২০ শতাংশ সুদহারে লিথিয়াম ব্যাটারিতে বিতরণ করছে। ব্যাংকের সুদহার ৪ শতাংশে নেমে আসলে গ্যারেজ মালিকরাও ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদেহারে ব্যাটারি কিনতে পারবেন। আগামী তিন বছরের মধ্যে ১৫ হাজার ইলেকট্রিক গাড়িতে স্মার্ট লিথিয়াম ব্যাটারি আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই।”