সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কিনতে পারছে না কেউ। সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি পাইকারিতেই। দাম ঠিক করার পর বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয়ের।
Published : 17 Mar 2024, 12:28 AM
চাল, আলু, পেঁয়াজ আর ডিমের মতই সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে খেজুরও কিনতে পারছে না ক্রেতারা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে ‘চুপচাপ’ বসে আছে। বেশি দামে বিক্রির জন্য কারা দায়ী, সেটি খুঁজে বের করা বা তাদের জবাবহিদিতার আওতায় আনতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঠিক করেছে, সাধারণ মানের খেজুরের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। কিন্তু ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে দুইশতে; বহুল ব্যবহৃত জাইদি খেজুরের দাম হওয়ার কথা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। কিন্তু কিনতে হচ্ছে তিনশ টাকায়।
যাদেরকে এই দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেই বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, তারা খোলা বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
বিক্রেতাদের দাবি, পাইকারিতেই খুচরায় বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ দরে খেজুর পাচ্ছেন না তারা।
তবে ফল আমদানিকারক ওই সংগঠনের এক নেতা বলছেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, তারা যে দামে বিক্রি করছেন, সেখান থেকে কিছুটা মুনাফা করলে বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি করা সম্ভব।
এই দুই ধরনের দাবির মুখে এখনও সরকারি কোনো সংস্থা মাঠ পর্যায়ে যাচাই বাছাই করে ব্যবস্থা নিয়েছে- এমন তথ্য নেই। আর রাজধানীর ফলের পাইকারি আড়ৎ বাবুবাজারের যে তথ্য মিলেছে, তাতে আমদানিকারকদের দাবির সত্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
প্রথমবারের মত খেজুরের দাম নির্ধারণ
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাধারণ মানুষ খায় এমন খেজুরের সর্বোচ্চ দাম ঘোষণা করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
দুই রকমের খেজুরের খুচরা মূল্য নির্ধারণে প্রথমে ফল আমদানিকারক সমিতিকে দায়িত্ব দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং বিষয়টি নিজস্ব কর্ম পরিধির বাইরে হওয়ায় খুচরা মূল্য নির্ধারণ করতে পারেনি সমিতি।
পরে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রোজা শুরুর আগের দিন ১১ মার্চ দুই ধরনের খেজুরের দাম ঠিক করে দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শাখা থেকে ‘খেজুরের খুচরা মূল্য নির্ধারণ’ বিষয়ক একটি চিঠিটি পাঠানো হয় এফবিসিসিআই সভাপতি ও বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বরাবর।
এতে বলা হয়, খেজুরের আমদানি মূল্য, শুল্ক ও কর এবং আমদানিকারকের খরচ বিশ্লেষণ করেই ‘যৌক্তিক মূল্য’ ঠিক করা হয়েছে।
আগের বছরের তুলনায় সরকার অনেকটাই বেশি দর ঠিক করে দিয়েছে। গত রোজায় দুই জাতের খেজুর পাওয়া যাচ্ছিল যথাক্রমে ১২০ ও ১৫০ টাকার মধ্যে। সেই হিসাবে এবার কেজিপ্রতি দাম বাড়ানো হয় ৩০ থেকে ৪৫ টাকা।
চিঠিতে খেজুরের পরিচয় নির্ধারণে একটি ‘নিম্নমানের’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। এ নিয়ে সমালোচনা হলে পরে তা সংশোধন করে ‘সাধারণ মানের’ লেখা হয়। এই ভুলের জন্য দুঃখও প্রকাশ করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।
বাজারের কী চিত্র
তবে রোজার চতুর্থ দিনে বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক বেশিতে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। সাধারণ মানের খেজুরের তুলনায় জাইদিতে দাম তুলনামূলক আরও বেশি।
রাজধানীর মিরপুর বড়বাগ কাঁচাবাজার এলাকায় খেজুরের দোকান নিয়ে বসা বিল্লাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাদামতলী থেকে তিনি জাইদি খেজুর কিনে এনেছেন প্রতি কেজি ২৭০ টাকায়, বিক্রি করছেন ৩০০ করে।
এই ব্যবসায়ীর দাবি অনুযায়ী, এই খেজুরের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের দেড় গুণ দাম পাইকারিতেই।
বড় বস্তার ভেতরে থাকা সাধারণ মানের খেজুর তিনি বিক্রি করছিলেন প্রতিকেজি ২০০ টাকায়।
যেসব খেজুরের দাম বেঁধে দেওয়া হয়নি সেগুলোর মধ্যে মরিয়ম খেজুরের কেজি এই ব্যবসায়ী রাখছেন এক হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩০০ টাকা বেশি; আজোয়া খেজুর রাখছেন ১ হাজার ১০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৭০০ টাকা।
দাম বেশি হওয়ার কারণে এবার বিক্রি কমও, বললেন বিল্লাল।
মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় বিক্রেতা মো. ফিরোজ বলেন, “দাবাস খেজুর কেনা পড়েছে ৩৪০ টাকা, আমি বেচি ৪০০ করে। বড়ই খেজুর কেনা পড়েছে ৩৬০ টাকা, সেটা বেচি ৪৫০ করে।”
বস্তা ভরে আসা সাধারণ মানের খেজুর ১৬২ টাকায় কিনে ২০০ টাকায় বিক্রির তথ্যও জানিয়েছেন।
অর্থাৎ মিরপুর বড়বাগারের বিল্লাল বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে পাইকারিতে জাইদি খেজুর পাচ্ছেন না, তেমনি সাধারণ মানের খেজুরের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ দামে পাইকারিতেই কিনতে পারছেন না ফিরোজও।
তিনি কালমি খেজুর বিক্রি করছেন ১০০০ টাকায়, আগের বছর যার দাম ছিল ৮০০ টাকা; মেটজুল আম্বার গত বছর ছিল এক হাজার টাকা, এবার রাখছেন ১ হাজার ২০০।
বিল্লালের মতো ব্যবসা ভালো না ফিরোজেরও। তিনি বলেন, “এ বছর বিক্রি একটু কম। কারণ, মানুষ খাচ্ছে না তো। দাম তো অনেক বেশি, তাই কম কিনছে।”
কারা দায়ী
চার দিনেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কেন খেজুর পাওয়া যাচ্ছে না- এই প্রশ্নে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নাসিরুদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে খেজুরের দাম বেঁধে দিচ্ছে। এই নিয়ম তো আগে দেখি নাই।
"আমরা এসব খোলা খেজুরের খুচরা মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করব? পাইকারি মূল্য হলে হয়ত একটা বিষয় ছিল। খুচরা দোকানে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে?”
সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, “মন্ত্রণালয়ের খুচরা মূল্য নির্ধারণের ওই চিঠি আমি এখন সামনে নিয়ে বসে আছি। আমরা তো খুচরা দাম নির্ধারণ করতে পারি না। এখন যারা খুচরা বিক্রি করে তাদেরকে এই নির্দেশ অনুসরণ করতে হবে।”
পাইকারি মূল্যও তো বেঁধে দেওয়া খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিরাজুল সেই তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, “জাইদি খেজুর প্রতিকেজি আমরা ১৪৭ টাকা থেকে ১৫২ টাকার মধ্যে বিক্রি করছি। খুচরায় কেজিতে ২০ টাকা লাভ করলে সেটা ১৭০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা কেজি ঠিকই আছে। আর নরমাল খেজুর আমার কাছে নাই। সেটার দাম সম্পর্কে বলতে পারব না।”
এই ব্যবসায়ী সঠিক তথ্য দিয়েছেন কি না, যেটি যাচাইয়ে ঢাকায় ফলের পাইকারি আড়ৎ বাবুবাজারের মেসার্স আর জেড এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা মঈন উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
তিনি জানান, জাইদি খেজুরের ১০ কেজির প্যাকেট বিক্রি করছেন ২ হাজার ৬০০ টাকায়। অর্থাৎ ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি যে দাবি করছেন প্রকৃত পাইকারি মূল্য তার চেয়েও ১০০টাকার বেশি।
সাধারণ মানের খেজুর বাজারে বুস্টার নামে পরিচিত জানিয়ে মঈন উদ্দিন বলেন, “আমার দোকানে এটা নাই। তবে ১৮০ কি ১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এই জাত।”
অর্থাৎ সাধারণ মানের খেজুরও খুচরায় যে দরে বিক্রি হওয়ার কথা ছিল, পাইকারিতেই দাম কেজিতে ৩০ টাকার মতো বেশি।
মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই, বক্তব্যও নেই
বেঁধে দেওয়া দরে বিক্রি হচ্ছে না খেজুর, তার দায় কার বা কাদের, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী ভাবছে বা কী করছে, পাওয়া যায়নি সে তথ্য।
বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ এ বিষয়ে প্রশ্ন শুনে জবাব না দিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে চলে গেছেন।
মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (আইআইটি) অনুবিভাগের নবনিযুক্ত প্রধান রেজওয়ানুর রহমানকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ - ক্যাব এর সভাপতি গোলাম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার তো অনেক পণ্যের দামই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তবে ভোক্তারা চায় সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার মাধ্যমে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখা। এখন দাম কার্যকরের দায়িত্ব তো সরকারের। ”
আলু-পেঁয়াজ ও ডিমের দাম নির্ধারণের পরও একই চিত্র
গত বছরের সেপ্টেম্বরে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে সরকার সেগুলোর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দেয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪-৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ঠিক করা হয় ১২ টাকা।
এই দাম নিশ্চিত করতে দৃশ্যমান চেষ্টা সবচেয়ে বেশি হয়েছে আলুর ক্ষেত্রে। হিমাগারগুলোতে চলেছে একের পর এক অভিযান। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি রাখায় জরিমানাও করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হল ক্রেতাদেরকে আলু ৭০ টাকাতেও কিনতে হয়েছে। পেঁয়াজের দর বেড়ে ১২০ টাকাও হয়, আর ডিমের দাম ডজন ১৬৫ বা তার চেয়ে বেশিও হয়।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে মিলগেটে সরু চালের পাইকারি মূল্য ৫১ টাকা ৫০ পয়সা আর মাঝারি চাল ৪৫ টাকা কেজিতে বেঁধে দিয়েও সেটির বাস্তবায়ন করা যায়নি।