Published : 30 Apr 2025, 08:09 PM
শতাধিক দেশের ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্র তিন মাসের যে স্থগিতা আদেশ দিয়েছে সেই সময়সীমা আরও বাড়ানোর অনুরোধ করা হতে পারে বাংলাদেশের তরফে।
ট্রাম্প প্রশাসনকে ‘না চটিয়ে’ আলোচানার মাধ্যমে সময় বাড়ানোর এই চিন্তার কথা তুলে ধরেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াব, আলোচনা করব কিন্তু ওদের চটাব না। ওদিকে আমরা কথা বলব। তিন মাস সময় দিছে, দরকারে আমরা আরও সময় চাব।”
ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর ও এফবিসিসিআই এর যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ৪৫তম পরামর্শক কমিটির সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন অর্থ উপদেষ্টা।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণায় বাংলাদেশের পণ্যে বাড়তি ৩৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়।
এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ, যা বেড়ে হল গড়ে ৫২ শতাংশে দাঁড়ায়।
এ ঘোষণা দিয়ে পুরো বিশ্বকে অস্থির করে তোলার এক সপ্তাহের মাথায় ৯ এপ্রিল তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা আসে।
তার আগে ৭ এপ্রিল সম্পূরক শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে ডনাল্ড ট্রাম্পকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চিঠি পাঠান।
তিন মাসের এই স্থগিতাদেশের সময়সীমা আরও বাড়ানোর চিন্তার বিষয়টি তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কথা হয়েছে এবং হচ্ছে।
এ সময় আইএমএফের চাপ ও ট্রাম্পের শুল্ক মাথায় রেখে আগামীর বাজেট ‘বাস্তবসম্মত’ হবে বলেও অর্থ উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেন ব্যবসায়ীদের।
তিনি বলেন, “এইবারের বাজেটের মূল উদ্দেশ্যটা হল, আমরা বাস্তবধর্মী একটা বাজেট করব। এমন বাজেট করব, যাতে সম্পদের ব্যবহার করতে পারব।
“চিরাচরিতভাবে যে বাজেট তুলে দেওয়া হয়, অনেক কিছু বলে যায়, পরবর্তী বছরে কি হল না হল এটা কেউ প্রশ্ন করে না। আমরা একটু সতর্ক। যেটা বলব সেটা চেষ্টা করব।”
এ সময় ব্যবসার লাইসেন্স নবায়ন করাসহ, ‘অপ্রচলিত’ কাগজপত্র এবং কিছু আইন যা ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে, তার পরিবর্তন ব্যবসায়ীরা দেখতে পাবেন বলেও অর্থ উপদেষ্টা তুলে ধরেন।
তবে বৈশ্বিক ও দেশীয় চাপ থাকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি বাড়ানোর সুযোগ না থাকার কথাও দৃঢ়ভাবে বলেন সালেহউদ্দিন।
তিনি বলেন, “একটা জিনিস আপনাদের মনে রাখতে হবে যে কর অব্যাহতির যুগ চলে গেছে। আমরা অনেক চাপে আছি। আপনাদের রাজস্ব বাড়াতে হবে আবার সরকারও চালাতে হবে। আপনাদের প্রণোদনা দিতে হবে সেজন্য টাকা আয় করা দরকার।
“এখন যদি বলেন যে সব রেয়াত (কর ছাড়) দিয়ে দেন। সবকিছু ছেড়ে দেবেন। কর আপনার (ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে) দিতে হবে। রাজস্ব দিতে হবে। একটা জিনিস মনে রাখবেন, রাজস্ব দেওয়া মানে কিন্তু আপনি মনে করছেন, আপনার দিকটা খরচ। আপনি এটা মনে করেন যে এটি ভিন্নও। আপনি যে কর দেন সেটা আপনার উপকারে আসবে। সমাজের অন্যান্য কাজের জন্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক পরিষেবা-এগুলো জন্য।”
৪৪৫ পৃষ্টার প্রস্তাব ব্যবসায়ীদের, ‘অস্পষ্ট’ বললেন বাণিজ্য উপদেষ্টা
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে এফবিসিসিআই এর তরফে একটি বই বানানো হয়েছে; ৪৪৫ পৃষ্টার এ বইয়ে বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের বাজেট প্রস্তাবনাও রাখা হয়েছে।
এটিকে ‘ঢাউস সাইজের’ বই মন্তব্য করে ব্যবসায়ীদের ‘দায়িত্বশীল’ হওয়ার কথা বলেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
তার ভাষ্য, “এই বইয়ের এই প্রস্তাবনা আমার পক্ষে পড়া অসম্ভব। এটা আমাকে রেখে যেতে হবে। এবং যে আকাঙ্ক্ষাগুলো করা হচ্ছে, যে প্রস্তাবনাগুলো করা হচ্ছে ,এই প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই খুবই বিস্মৃত এবং আকাঙ্খাগুলো অস্পষ্ট, মানে প্রস্তাবনাগুলো অস্পষ্ট।
“মানে যে আমরা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারি এই জিনিসগুলো অস্পষ্ট। আমাদের ব্যবসায়িক প্রতিনিধিত্ব যারা করেন, নেতৃত্বের যারা প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা সুষ্ঠভাবে আমাদের আয় ব্যয়ের একটা স্থিতি হিসেব করে, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার যে ব্যয় এটা তো তাদের থেকে আসতে হবে। আমাদের যে কর যদি আমরা আদায় না করতে পারি তাহলে আমরা একটা শক্ত রাষ্ট্র গঠন করতে পারবো না। আমাদের সরকার দুর্বল থাকবে এবং এটা অবশ্যই নাগরিক হিসেবে আমাদের কাম্য হতে পারে না।”
এ সময় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন খাত থেকে কর অব্যাহতি চাওয়ার সমালোচনাও করেন তিনি।
তার ভাষ্য, “আমরা যে জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি যে আমরা সকলেই সকল ধরনের কর অব্যাহতি চাচ্ছি। সরকার পরিচালনার জন্য এবং দেশের রাষ্ট্রের উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের দরকার আছে। এবং আমরা প্রতিবছরই দেখছি যে এনবিআরকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের দায় দেওয়া হচ্ছে।
“আমরা যখন, মানে দায়িত্ব না নিয়ে প্রস্তাবনাগুলো দিব তখন এনবিআরও দায়িত্ব না নিয়ে বিভিন্ন রকমের কর আমাদের উপরে আরোপ করবে।”
ঢাউস আকারের প্রস্তাব না এনে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এনবিআরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব কী?
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান তার প্রস্তাবনায় বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি যে গত অনেক বছর ধরে আমরা কর জাল সম্প্রসারণের বিষয়ে আলাপ আলোচনা করছি। কিন্তু এ বিষয়ে তেমন বিশেষ কোন অগ্রগতি নাই সাধারণত। ১ কোটি ১৪ লাখ করদাতার মধ্যে মাত্র ৪৫ লাখ দেন রিটার্ন, তার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই শূন্য রিটার্ন দেন।
“এইটার পরিবর্তন, গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন এবং এই বিষয়ে যেটা আমরা লক্ষ্য করেছি, উদ্বেগজনক যে কর জাল না বাড়িয়ে বিদ্যমান করদাতাদের উপরে বিভিন্ন রকম চাপ অব্যাহত রয়েছে।”
এ সময় কার্যকর কর হার কমানোরও প্রস্তাব আসে তার তরফে।
এমসিসিআই সভাপতির ভাষ্য, “আমরা প্রতিবছরই এটা বলে এসছি যে আমাদের যদিও আয়করের হারের ব্যাপারে বিভিন্ন বক্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু যেই হারটা আছে সেটা থেকেও অনেক বেশি হারে আমাদের কর দিতে হচ্ছে। কারণ হচ্ছে বাস্তবিক কর হার অনেক।” এ বিষয় এফবিসিসিআই এর প্রস্তাবনায় কিছুটা এসেছে তুলে ধরে তিনি বলেন, এটি যৌক্তিক করা খুবই প্রয়োজন।
কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে রাজস্ব আহরণের সমালোচনা করে অন্যান্য জেলায়ও নজর দেওয়ার প্রস্তাব করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
তিনি বলেন, “ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে রাজস্ব আসতেছে ৮৪ শতাংশ। বাকিগুলা থেকে কোন আয়ই আসছে না। ঘটনাটা এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাসায় ৬৪টা ছেলে আছে, দুইটা ছেলে আয় করে পুরা বাড়ি চালাচ্ছে। এতে কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান হবে না।”
তিনি মনে করেন, এই ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক খাতকে কীভাবে কর জালে আনা যায় এই বিষয়ে জরুরি কাজ করা খুব প্রয়োজন।
বর্তমান সময়ে এনবিআরের শুল্কের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের হয়রানি মাঠ পর্যায়ে কমার তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “তবে বন্ড (শুল্কের) কমিশনারেটের নিচের স্তরে কিছু সমস্যা এখনো আছে, সেই জায়গাটা, আমি একটু অনুরোধ করব একটু দৃষ্টি দেওয়ার জন্য।”
এছাড়াও ভ্যাটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনের মারপ্যাচে নানানভাবে হয়রানি হতে হয় বলেও তুলে ধরে ভ্যাটের বিভিন্ন ধরণের কাগজ-প্রমাণ কমানোর পক্ষে প্রস্তাব আসে তার তরফে।
এছাড়াও বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে সোলার আমদানির শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেন হাতেম।
সভায় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে ৪০ জন প্রতিনিধি কথা বলেন; এ সময় ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসাসহ গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার তাগিদ আসে অনেকের তরফে।