Published : 25 Mar 2011, 01:05 AM
আজ জাতির বিবেক হাজার বছরের ঐতিহ্য মহাস্থানগড়ের নির্মম ধবংসযজ্ঞে ভূলুণ্ঠিত আজ জাতির বিবেক
ইতিহাস ঐতিহ্যের পীঠস্থান বগুড়ার মহাস্থানগড়ের অতি সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ টি শুরু করা হয় গত বছরের ২৭ শে নভেম্বর যার বিরুদ্ধে দেশের ঐতিহ্য সচেতন ব্যক্তিবর্গ তৎক্ষনাৎ তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করলেও তা সাড়ম্বরে চলতে থাকে। মহাস্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের কাস্টডিয়ান নাহিদ সুলতানা স্থানীয় সুধীজন ও সাংবাদিকদের সহায়তায় এর বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নেন এবং প্রতিরোধের চেষ্টা করেও প্রভাবশালী মহলের চেষ্টায় বার বার ব্যর্থ হন। একটি কথা প্রসঙ্গত উলেখ করা যেতে পারে, অতীত নিদর্শনে ভরপুর মহাস্থানগড়ের যে কোন স্থানে একটু খনন করলেই সেখানে মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক দেখা মেলে।
আর তাতেই উৎসাহিত হয়ে এখানকার অতীত নিদর্শনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো কোন পুরাতন ঘটনা নয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি স্থানীয় শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের কর্মসৃজন প্রকল্পের আওতায় একটি রাস্তা নির্মানে বড় টেঙরা ধাপের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হয়। গত ২০১০ সালের ৭ই ডিসেম্বর এই মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদে হিউম্যান রাইটস ফর পিস ইন বাংলাদেশ এই ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারা সংবিধান লংঘনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করে।
বাংলাদেশে সংবিধানে জাতীয় ঐতিহ্য সমূহ সংরক্ষণে এর অন্তর্ভূক্ত অংশে পুরাকীর্তির ক্ষতিসাধন করে যে কোন স্থাপত্য নির্মান আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাইকোর্ট একটি বেঞ্চ এই নির্মানের নামে ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে দ্রুত রুল জারি করে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা, বিভাগীয় কমিশনার আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মদদে হাইকোর্টের রুল ভঙ্গ করে এই এলাকাতে অবৈধভাবে খনন পরিচালনা করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি মহাস্থানগড় সংযুক্ত একটি ঢিবি নিতাই ধোপানীর পাটের মাটি সরিয়ে সেখান দিয়ে রাস্তা নির্মাণের উদ্দেশ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক অপর একটি কর্মসৃজন প্রকল্প হাতে নেয়া হলে তৃণমূল পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ স্থানীয় সাংবাদিকরা দ্রুত এর প্রতিবাদ জানান।
হাইকোর্টের ওই একই বেঞ্চ দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তাদের অধিকাংশই সরকারী আমলা পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁদের ধারণাও সুস্পষ্ট নয়। পাশাপাশি এলাকার প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ মদদে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নজর এড়াতে এখন রাতের আঁধারে খনন কাজ চলছে।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে শ্রমিক লাগিয়ে মাজার উন্নয়ন কমিটির পক্ষে মহাস্থানগড়ের মূল মাজার এলাকায় উঁচু স্থানের ওপর প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ পুণ্ড্র গেট বা 'পুণ্ড্র নগরীর প্রবেশদ্বার' এলাকায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ির মাধ্যমে এই স্থানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ব্যপক ক্ষতি সাধন করা হয়।
খননের সময় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ মহাস্থানগড়ের মাটির নিচ থেকে প্রচুর প্রত্ন নিদর্শন বের হয়ে আসলে সেগুলো গুম করতে নিকটবর্তী একটি স্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয় যেগুলো গত বুধবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করেন।
প্রত্যক্ষ্যদর্শী, এলাকবাসী ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভাষ্যমতে, রাত ১২টার পর লোকচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে শ্রমিক লাগিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। তাঁরা সবাই গভীর রাতে শ্রমিকদের কাজ করার প্রমাণ হিসেবে সকালে পুণ্ড্র গেট সংলগ্ন স্থানে বালি বিছানো দেখতে পান।
পরে আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, সেখানে রাতে শ্রমিকরা খনন কাজ করেছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই স্থানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান নাহিদ সুলতানার অভিমত 'অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, যারা খনন কাজ করেছে তারা প্রথমে চিন্তাই করেনি সেখানে প্রাচীন নিদর্শনাবলি থাকতে পারে।পরে নিদর্শনগুলো বের হয়ে আসলে সেগুলো গুম করতে রাতেই সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
প্রচেষ্টা হিসেবে আগেই খুঁড়ে রাখা একটি গর্তের মধ্যে নিদর্শনগুলো ফেলে মাটি চাপা দেয় তারা। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তা কর্মচারী গন গত বুধবার সকালে আলগা নতুন মাটি দেখে সন্দেহ হলে মাটি সরাতে শুরু করেন। তাঁরা মাটি সরিয়ে ব্যাক স্টোন, প্রাচীন স্থাপত্যের অংশ হিসেবে ইট, অমূল্য কিছু টেরাকোটা নিদর্শন ও মূর্তির ভগ্নাংশ উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
এ ঘটনার পর থেকে অপকর্মের নায়ক সহ প্রায় সকল কুশীলব এবং মহাস্থান মাজার উন্নয়ন কমিটির নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। পাশাপাশি এই ঘটনাটি প্রকাশ না করার হেতু তাঁদের মাঠকর্মীদেরও বিভিনড়ব ভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী বারবার খননের জন্য লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঠিক করা স্থানটির নিচেই লুকিয়ে থাকতে পারে ইতিহাস ঐতিহ্যের পুণ্ড্র নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভবন। কারণ মূল মাজার ও মসজিদ সংলগ্ন টিলার মতো উঁচু জমিটি মূল পুণ্ড্র নগরীর অংশ যেখানে বসবাস করতেন রাজা তাঁর অমাত্যবর্গ।
ফলশ্রুতিতে পুণ্ড্র রাজার রাজপ্রাসাদ ও প্রশাসনিক ভবন এখানেই থাকার কথা। জমিটি মাজার কমিটির বলে দাবি করা হলেও সংবিধান অনুযায়ী এটি প্রত্নতত্ব বিভাগের আওতায় পড়ে।এখানে ইচ্ছে করলেই কেউ খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু তাঁদের লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাতের আঁধারে খোঁড়াখুঁড়ির প্রাপ্ত অমূল্য প্রত্ন সামগ্রী অবলীলায় হাপিস করা হচ্ছে। নাহিদ সুলতানা জানান, তিনি ঘটনাটি দেখার পর এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেও তেমন কোন ফল পাননি।
গত বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুণ্ড্র নগরীর নিদর্শনগুলোর একেবারে কেন্দ্রস্থলে হজরত শাহ সুলতান বলখি মাহি সওয়ারের (রা.)-এর মাজারের পশ্চিম পাশে প্রায় ২০০ বর্গফুট এলাকায় খনন কাজ করা হয়। এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের জাতীয় গৌরবের একটি অংশ কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
———————————
সূত্র:বাংলাদেশ ফার্স্টডটকম