Published : 10 Dec 2011, 08:12 AM
স্যাম ২৫ বছরের উচ্চশিক্ষিত একজন যুবক। সে ঢাকায় বসবাসরত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ছয় বছর আগে, উনিশ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রী শেষ করার পর সে আবিষ্কার করলো যে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক রীতি থেকে তার যৌণ প্রবনতা আলাদা। বর্তমানে একজন পুরুষের সাথে তার রোমান্টিক সম্পর্ক রয়েছে। আগে তার নারীদের সাথেও যৌণ সংযোগ ঘটেছিল এবং নিজেকে সে উভকামী (Bisexual) হিসেবে বিবেচনা করে। স্যাম এবং তার পুরুষ বন্ধুটি একসাথে ঘুরে বেড়ায়, ঢাকার রাস্তায় হাত ধরাধরি করে হাঁটে এবং যখন একে অন্যের বাসায় যায় তখন একই বিছানায় শোয়। যেহেতু বাংলাদেশে দু'জন পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ঐতিহ্যগতভাবে খুবই স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচ্য, সে কারণে এই গোপন চর্চ্চা তাদের অনুমানকৃত বিষমকামি (Heterosexual) পরিচয়ের উপর কোন সন্দেহের ছায়া পড়তে দেয় না। স্যাম ও তার পুরুষ বন্ধুটির সম্পর্ককে পরিবার এবং বন্ধুরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হিসেবে মনে করে। স্যামের ব্যাখ্যা, "যতক্ষন পর্যন্ত আপনি আপনার পরিবারের কাছ থেকে এটা লুকিয়ে রাখবেন, ততক্ষন পর্যন্ত আপনি নিরাপদ।" স্যাম তার প্রকৃত নাম নয়। সম্ভাব্য সামাজিক এবং আইনি পরিণতি সম্পর্কে ভীত স্যাম শুধুমাত্র ছদ্মনামেই কথা বলতে রাজী হয়েছে।
স্যাম ও তার পুরুষসঙ্গীর মতো বাংলাদেশে বহু সমকামী নিজেদের পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের যৌণ প্রবণতা লুকিয়ে রেখেছে। "একজন সমকামীর পক্ষে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রেখে মোটামুটি একটি জীবন যাপন করা সহজতর।" মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে সমকামীতা সবসময় পাপ হিসেবে গণ্য। ফলে এই চর্চ্চাটি প্রকাশ্য হলে তার পরিণতি খুবই কঠোর। কিছু সমকামী পুরুষ তাদের যৌণ ঝোঁক বা প্রবণতা পরিবারের কাছে প্রকাশ করায় তাদের বিষমকামী বিয়েতে বাধ্য করা হয়। অনেক অভিভাবক সমকামীতাকে একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তাদের সমকামী পুত্রদের ধর্মপোদেশ দেন বা মনোচিকিৎসকের শরনাপন্ন হন। স্যাম বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনাও শুনেছে যেখানে সমকামী পুরুষদের তথাকথিত মানসিক রোগ উপশমের জন্য তাদের বৈদ্যুতিক শক্-ও দেয়া হয়। সে নিশ্চিত যে, "যতক্ষন না সরকার, বাবা-মা এবং বন্ধুরা না বুঝবে যে একজন নারী অথবা পুরুষ সমকামী হয়েও একজন ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান, হিন্দু বা খ্রীষ্ঠান হতে পারে, ততক্ষন পর্যন্ত বাংলাদেশে LGBT (Lesbian, Gay, Bisexual, Transgender) গোষ্ঠীর আধিকারের সুযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ।" বাংলাদেশের সমাজ এর থেকে অনেক দূরে। পুরুষদের সমকামীতাকে নৈতিকতা বঞ্চিত পাশ্চাত্যীয় ঘটনা হিসেবে দেখা হয়, যার আক্রমন থেকে নিজেদের রক্ষা করা দরকার। "যদিও বেশীর ভাগ মানুষের কাছেই পুরুষ সমকামীতার অস্তিত্ব স্বীকৃত, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের স্বপনেও নারী সমকামীতার অস্তিত্ব নেই।"
সামাজিক এবং ধর্মীয় নিষেধ বা ট্যাবু হিসেবে সমকামীতা সম্পর্কে সাধারন দৃষ্টিভঙ্গী বাংলাদেশী ক্রিমিনাল কোডেও প্রতিফলিত হয়েছে। বৃটিশ আইনের ধারাবাহিকতায় এই কোডের ৩৭৭ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, পারস্পরিক সম্মতিক্রমে মুখমেহন ও মলদ্বারের যৌণক্রিয়া "প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার বিপরীতে একটি কামজ মৈথুন ক্রিয়া" এবং এর শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কার্যকরীভাবে এই ধারা বাংলাদেশে সমকামী যৌণক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষনা করেছে। মজার ব্যাপার হলো, ৩৭৭ ধারার অধীনে অভিযুক্তি খুবই বিরল। ফলে ৩৭৭ ধারা বিশ্বে বাংলাদেশের মধ্যম-উদার ইমেজের কোন ক্ষতি করেনি এবং সমকামী ইস্যুতে দেশের মানবাধিকারের রেকর্ডের প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র আদালতেই নয়, সংবাদ মাধ্যমগুলোর মূল স্রোতেও এই ইস্যুটি বিশেষভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ফলে LGBT গোষ্ঠী বাধ্য হয়েছে এর ছায়া অস্তিত্বে বা আড়ালে থাকতে এবং এর কন্ঠও প্রকাশ্য পরিমন্ডলে কার্যকরীভাবেই নিশ্চুপ। যাহোক, নতুন মাধ্যম (Media) গুলোর কারণে সময় বদলাচ্ছে।
২০০২ সালে একটি অন্তর্জালিক বা অনলাইন গ্রুপ হিসেবে Boys of Bangladesh (BOB) নামের একটি সংস্থা তাদের যাত্রা শুরু করে। তারা অচিরেই বাংলাদেশের সমকামী ও উভকামীদের কেন্দ্রীয় ফোরামে পরিণত হয়। ইদানিং BOB –এর রয়েছে ছাত্র এবং পি এইচ ডি ধারী সহ দুই হাজারেরও বেশী নিবন্ধিত সদস্য। তাদের বয়সের সীমা ষোল থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে। বিশজন তরুণ ছেলে BoB –এর কার্য্য পরিচালনা করছে এবং ইদানিংকালে ক্রমেই তারা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালের নভেম্বরে "রংধনুর নীচে" নামের শিরোনামে তাদের দ্বিতীয় উৎসবটি ঢাকার জার্মান গ্যাটে ইন্সটিটিউট-এর সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়। এর স্লোগান ছিল, "বৈচিত্র্য গ্রহন করো, বৈষম্যের অবসান করো।" পাঁচ দিনের এই উৎসবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, চিত্রকলা প্রদর্শনী আর সংগীতের মেলা বসে এবং দেশী-বিদেশী বহু নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদেরও জমায়েত ঘটে। গ্যেটে ইন্সটিটিউট-এর পরিচালক আঙ্গেলা গ্র্যুনার্ট বাংলাদেশের LGBT আন্দোলনে তার সংশ্লিষ্টতার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ অথবা যৌণ প্রবনতার উর্ধ্বে "সকলেরই সমাজে সমান অধিকার আছে।" প্রধানতঃ ঢাকায় BoB আরও অনেক অনুষ্ঠান সংগঠিত করেছে এবং এর প্রতিনিধিরা এই LGBT ইস্যুতে নেপাল এবং থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিয়েছে। নীচে উল্লেখিত ওয়েব সাইটে এই সংস্থা বাংলাদেশী সমকামীদের স্বাস্থ্য এবং আইনী ব্যাপারে আরও তথ্য সরবরাহ করছেঃ
http://boysofbangladesh.org/
এই উপমহাদেশের বৈধ মাধ্যমগুলোতেও পরিবর্তন আসছে। ভারতের রাজধানী দিল্লীর একটি আদালত ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ভারতীয় ক্রিমিনাল কোড-এর ৩৭৭ ধারাকে রদ করেছে সমকামী যৌণসংগমকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যৌণক্রিয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা একটি মৌলিক মানবিক অধিকার লঙ্ঘন। সাম্যের কাছে এটি একটি আশার লক্ষন। সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রগাঢ় সাংস্কৃতিক যোগাযোগ থাকার কারণে ভারতীয় আদালতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে LGBT ইস্যুতে একটি প্রকাশ্য বিতর্কের স্ফূরণ ঘটাবে এবং এখানকার তরুণ সমকামীদের তাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে উৎসাহিত করবে। "তরুণরাই আন্তর্জাতিক মাধ্যমে উন্মোচিত এবং ক্রমোঃশিক্ষিত। তারাই বাংলাদেশের LGBT আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে।"
ইসলামের কিছু আন্দোলন, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আল-ফাতিহা ফাউন্ডেশন সমকামীতাকে প্রাকৃতিক হিসেবে গ্রহণ ও স্বীকার করে নিয়েছে; এবং বৈশ্বিক মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে অ-বিষমকামী (non-heterosexual) প্রেমের সম্পর্ককে স্বীকার করে নেয়ার পক্ষে কাজ করে চলেছে। বিশ্বব্যাপী প্রগতিশীল মুসলমান পন্ডিতেরা যুক্তি সেখান যে, আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপটে সমকামীতা সম্পর্কে কুরআনের বাণী সেকেল এবং তারা উল্লেখ করেন যে, সমকামী লালসার বিপক্ষে কুরআন কথা বললেও সমকামী প্রেম সম্পর্কে কুরআন নিশ্চুপ। যাহোক, বাংলাদেশে LGBT অধিকারের পক্ষে সবচেয়ে এবং একমাত্র অপ্রতিরোধ্য বাধা হিসেবে ধর্মই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে LGBT অধিকার আন্দোলন খুব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ৩৭৭ ধারা বাতিল করার পক্ষের কন্ঠস্বরগুলো ক্রমেই বেশ সোচ্চার হচ্ছে। এই ইস্যুটি এই তরুণ জাতির ধর্মীও এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতিতে মানবাধিকার ও আধুনিকতার একটি প্রকাশ্য যুদ্ধ হিসেবে দেখা দিতে বাধ্য এবং নীতিনির্ধারক, ধর্মীয় শাসক ও সুশীল সমাজের নেতাদের কাছে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।
রাইনার এবার্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নৈতিক দার্শনিক। তিনি প্রাণী অধিকার ও বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের বিভিন্ন ইস্যুতে বিশেষায়িত হবার কাজে নিয়োজিত। রাইনার এবার্ট-এর অন্তর্জালিক ঠিকানাঃ
মাহমুদুল হক মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধিনে Centre for Practical Multimedia Studies এর স্থপতি পরিচালক। তাঁর আগ্রহের জায়গাগুলো হলো মানবাধিকার ইস্যু, সামাজিক ন্যায়বিচার, ক্রীড়া মিডিয়া ও ভিসুয়াল কমিউনিকেশান। মাহমুদুল হক মনি'র অন্তর্জালিক ঠিকানাঃ