জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদ ও কলম্বাসের মূর্তিপাত

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 24 July 2020, 08:10 PM
Updated : 24 July 2020, 08:10 PM

গত ২৫ মে আমেরিকার মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে মারা যায় জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।  ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে আমেরিকার অনেক শহরে সহিংস প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে কৃঞ্চাঙ্গ ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে হলেও তা ক্রমান্বয়ে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই আন্দোলন এক পর্যায়ে বর্ণবাদ সমর্থনকারী ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের মূর্তি ভাঙ্গার দিকেও মোড় নেয়। প্রতিবাদকারীরা মার্কিন  গৃহযুদ্ধের ফেডারেট বাহিনীর রাষ্ট্রপতি জেফারসন ডেভিসের মূর্তি থেকে শুরু করে আমেরিকার আবিষ্কারক  ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তি পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়েছে।


আন্দোলনকারী কালো মানুষগুলোর এ ক্ষোভ ও ঘৃণার ঐতিহাসিক  ভিত্তি অনস্বীকার্য।
১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর নতুন মহাদেশের সহায়সম্পদ খুব দ্রুত ইউরোপে স্থানান্তরিত হতে থাকে। সম্পদের মধ্যে খনিজ দ্রব্য সোনা, রূপা, বনজ গাছগাছড়া কিংবা খাদ্য-শস্যের বাইরে মূল সম্পদ ছিল ঐ দেশের স্থানীয় বাসিন্দা বা রেড ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। রেড ইন্ডিয়ানদের গরু -ছাগলের মতো ধরে ধরে জাহাজ ভর্তি  করে কলম্বাস ও তার উত্তরসুরিরা ইউরোপের বাজারে দাস হিসেবে বিক্রয় করতে থাকে।


এক পর্যায়ে আমেরিকায়
উপনিবেশ ও কৃষিকাজ শুরু হলে রেড ইন্ডিয়ানরা তাদের নিজ দেশেই দাসে পরিণত হয়। এরপর আফ্রিকা থেকে কালো মানুষগুলোকে জোর করে ধরে নিয়ে দাসরূপে আমেরিকায় বিক্রয় শুরু হয়। আমেরিকার সাথে উইরোপের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসাই ছিল দাস ব্যবসা। প্রায় চারশত বছর ধরে চলে এ দাস ব্যবসা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ  পর্যন্ত আফ্রিকার কালো মানুষগুলো আমেরিকার উপনিবেশে দাসরূপেই বাস করতে থাকে।

ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে যখন দাস ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করা হয় তখন দাস ব্যবসায়ীদের মূল ব্যবসা টিকে ছিল আমেরিকান উপনিবেশগুলোতে। ১৮৩৩ সালে ব্রিটেনে ও ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সে দাসপ্রথা বেআইনি ঘোষণা করে আইন পাস হলেও  যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।


এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দাস প্রথার সমর্থকদের মধ্যে এর প্রতিষ্ঠাতা নেতারাও ছিলেন।  আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের অবতরণিকাতে লেখা ছিল,  "আমরা এ সত্যকে সত্য বিশ্বাস করি যে সকল মানুষকে সমান অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তারা তাদের স্রষ্টার কাছ থেকে কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার লাভ করেছে যাদের মধ্যে জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সুখলাভের প্রচেষ্টা অন্যতম।"

কিন্তু বাস্তব সত্য হল,  এ ঘোষণাপত্র গ্রহণকালীন স্বাধীনতার নায়কগণ কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ বলেই মনে করেননি।  ঘোষণাপত্রের মূল লেখক ছিলেন টমাস জেফারসন। তিনি যখন এ ঘোষণাপত্রটির খসড়া প্রস্তুত করেন এবং যখন এটা কংগ্রেসে গৃহীত হয়, তখনও টমাস জেফারসনের মালিকানায় কয়েক হাজার দাস ছিল। বস্তুত মানুষ বলতে ঐ সময় তারা মূলত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়াদেরই বুঝতেন।  তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে এখন তারা বা আমরা যা বুঝি, আমেরিকান সাদা মানুষগুলোর অধিকারে থাকা দাসগুলোর জন্য তা বোঝান হত না।

তবে এ কথাও ঠিক যে আপন উপলব্ধিতেই হোক, আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপেই হোক,  পরবর্তীতে আমেরিকার জাতীয় নেতৃত্ব দাসপ্রথা বিলোপের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। দাসপ্রথা বিলোপের অঙ্গীকার নিয়ে ১৮৬১ সালে ক্ষমতায় আসেন আব্রাহাম লিঙ্কন। কিন্তু তার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই দাসপ্রথার সমর্থক দক্ষিণের কয়েকটি রাষ্ট্র আমেরিকান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গিয়ে কনফেডারেট স্টেইটস অব আমেরিকা নামে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।

এ গৃহযুদ্ধের অনেক কারণ থাকলেও আমেরিকার সমাজ থেকে দাসপ্রথা বিলোপের পক্ষে আব্রাহাম লিঙ্কনের অবস্থানই ছিল মূল। আব্রাহাম লিঙ্কন ও তার রিপাবলিকান দল তার ক্ষমতাকালীন পুরো সময়টিই দাস প্রথার পক্ষের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

উত্তরের শিল্পোন্নত রাজ্যগুলো ছিল দাস প্রথা বিলোপের পক্ষে। দক্ষিণের কৃষি প্রধান রাজ্যগুলো ছিল বিলোপের বিপক্ষে মানে দাস প্রথা চালু রাখার পক্ষে। দক্ষিণের কৃষি প্রধান রাষ্ট্রগুলোর শিল্প বলতে তেমন কিছু ছিলনা। তারা উৎপাদন করত তুলা। সেই তুলা ও তুলা থেকে তৈরি সূতাই ছিল তাদের মূল রপ্তানিযোগ্য পণ্য যা রপ্তানি করা হত ইউরোপে।

কৃষি ও তাঁত শিল্প উভয়েই হল অত্যন্ত শ্রমঘন পেশা। দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মূল আর্থিক ভিত্তিই ছিল দাসদের ব্যবহার করে তুলা ও সূতা উৎপাদন করা। দাস প্রথা বিলুপ্ত হলে তারা দ্রুত আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে বলেই মূলত তারা ছিল দাস প্রথার পক্ষে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের যুদ্ধে অবশেষে দাস প্রথার পক্ষের শক্তিগুলোর পরাজয় ঘটে। কনফেডারেট বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী জেফারসন ডেভিসকে রাষ্ট্রদ্রহের মামলায় গ্রেফতার করা হয়। আব্রাহাম লিংকন সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে টিকে থাকেন। 


গৃহযুদ্ধ চলাকালীন ১৮৬২ সালেই দাস প্রথার পক্ষের রাজগুলোর দখলে থাকা দাসদের মুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জটিল ফেডারেল ব্যবস্থায় কোনো ফেডারেল আইন সহজেই সবার জন্য প্রযোজ্য হয় না। এজন্য তাদের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীয় আনা হয়।  ১৯৬৫ সালের ৩১ জানুয়ারি কংগ্রেসে এ সংশোধনী পাস হলেও তা স্থায়ী রূপ পেতে আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৬৫ সালের  ৬ ডিসেম্বর জর্জিয়া অঙ্গরাজ্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুমোদন করার মাধ্যমে তা সংবিধানের স্থায়ী অংশ হয় এবং আমেরিকান সমাজ থেকে দাসপ্রথা সাংবিধানিকভাবে বিলুপ্ত হয়।

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদকারীগণ আজ যে সব নেতার মূর্তি উৎপাটন করছেন তাদের মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে জেফারসন ডেভিস। যদি ১৮৬৫ সালের যুদ্ধে আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে ইউনিয়ন বাহিনীর পরাজয় ঘটত তবে জেফারসন ডেভিসের ফেডারেলিস্ট বাহিনী পুরো আমেরিকার নেতৃত্ব গ্রহণ করে আমেরিকার কালো মানুষগুলোর দাসত্বকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করত।

বিশ্ব রাজনীতির নানাবিধ পরিবর্তনের ফলে দাস প্রথার প্রবক্তারাও শেষ পর্যন্ত হয়তো দাস প্রথার বিরুদ্ধে আবস্থান নিতে বাধ্য হত। কিন্তু তার জন্য কৃঞ্চাঙ্গ মানুষগুলোকে হয়তো আরো একশ বছর অপেক্ষা করতে হত, প্রাণান্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হত। কারণ, এ পৃথিবীতে সাংবিধানিক বর্ণবাদের অস্তিত্ব ৯০'র দশকে নেলসন ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত টিকে ছিল। তাই বর্ণবাদের প্রবক্তা জেফারসন ডেভিসের প্রতি কালো মানুষগুলোর ক্ষোভ থাকা অতি স্বাভাবিক।

তবে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তি ভাঙ্গার বিষয়টি পুরোপুরি সমর্থন করা যায় না। এ কথা সত্য যে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ফলে ঐ ভুখণ্ডের রেড ইন্ডিয়ানদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছিল । আফ্রিকার কালো মানুষগুলো দাস ব্যবসার শিকার হয়ে আমেরিকায় পাচার হয়েছিল। কিন্তু এ সাথে এটাও সঠিক যে আমেরিকা আবিষ্কৃত না হলে কিংবা দাসরূপে পাচার না হলে  কালো মানুষগুলো আজ আমেরিকার মোট জনগোষ্ঠীর ১৩ শতাংশ হতে পারত না।

তাছাড়া যে সময় আমেরিকায় দাস ব্যবসার রমরমা ছিল ঐ সময় সারা পৃথিবীতেই দাস প্রথা চালু ছিল। দাস প্রথা মানব সভ্যতারই সমবয়সী। কৃষিভিত্তিক সমাজের সূচনা থেকেই পৃথিবীতে দাস প্রথা চালু হয়। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর উন্নতির মূলেও ছিল দাসদের অমানবিক ব্যবহার। আর আফ্রিকান কালো মানুষগুলো আমেরিকা আবিষ্কারের বহু পুর্ব থেকেই এশিয়া ইউরোপে দাসরূপে বিক্রয় হত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো সভ্যতার কোনো সমাজেই দাসদের মানবিক মর্যাদা প্রদানের ইতিহাস নেই। একইভাবে শ্বেতাঙ্গ সমাজে কালো মানুষদের সমান মর্যাদা প্রদানের ঘটনাও ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ছিল না। তাই দাস প্রথার প্রবর্তন, প্রচলন কিংবা কালো আমেরিকানদের দুর্দশার জন্য পঞ্চদশ শতকের ক্রিস্টফার কলম্বাসকে দায়ী করার কোনো কারণ নেই।